UMMA TOKEN INVESTOR

About me

"I am my own self — a journey full of flaws and imperfections. Yet I strive to let every shadow of my being be colored by the light of the Prophet (ﷺ)." — Saeed.

Followings
0
No followings
Translation is not possible.
স্মৃতিস্তম্ভের পায়তলে আজ তাজা রক্তের দাগ,
উড়ালপুলের ওপর থেকে নামল মৃত্যুর ডাক।
সিয়াম নামের স্বপ্নগুলো নিমিষেই হলো ছাই,
মায়ের কোলে ফিরল না সে, রাজপথে পেল ঠাঁই।
 
তোমাদের ওই ক্ষমতার দম্ভে জীবন যায় লুটি,
রাজনীতির এই দাবাখেলায় আমরা হলাম ঘুঁটি।
কার ইশারায়, কার স্বার্থে ঝরছে এমন প্রাণ?
গদির মোহে অন্ধ তোমরা, বধির তোমাদের কান।
 
সিংহাসন কি খুব জরুরি? রক্তের চেয়েও দামি?
বিচারহীন এই অরাজকতায় আর কতকাল থামি?
লাশের ওপর সিঁড়ি গড়ে ওপরে ওঠার নেশা,
এই শহরেই মানুষ মারা এখন নতুন পেশা।
 
মগবাজারের পিচঢালা পথ দিচ্ছে অভিশাপ,
ক্ষমতার এই নগ্ন খেলায় বাড়ছে কেবল পাপ।
বিচার চাই, জবাব চাই—অকালে কেন মরল ভাই?
 
Syed Mucksit Ahmed
image
Send as a message
Share on my page
Share in the group
Translation is not possible.
ফজরের আজানের ঠিক আগমুহূর্তে ঘুমটা ভেঙে গেল। মোবাইলের অ্যালার্ম বাজার আগেই। গত কয়েকদিন ধরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। আগে অ্যালার্মের শব্দে বিরক্তি লাগত, মনে হতো আরেকটু ঘুমাই। কিন্তু এখন মনে হয়, এই অ্যালার্মটা আসলে কোনো যান্ত্রিক শব্দ নয়, এটা ইসরাফিলের শিঙার মতো আমাকে সতর্ক করছে—"ওঠো! সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। তোমার আমলনামা এখনো বড্ড হালকা।"
 
লেপ সরিয়ে উঠে বসলাম। মাঘের শেষ দিকের শীতটা বেশ কামড় বসিয়েছে। জানালার কাঁচ ঝাপসা। আমি আঙুল দিয়ে কাঁচের ওপর একটা দাগ কাটলাম। বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু এই অন্ধকারের বুক চিরেই তো আলো আসে। আমাদের উম্মাহর অবস্থা এখন ঠিক এই অন্ধকারের মতো। আমরা অপেক্ষা করছি একটা ভোরের। কিন্তু ভোর তো এমনিতে আসে না, সূর্যকে যেমন জ্বলে-পুড়ে উঠতে হয়, তেমনি বিজয়ের ভোর আনতে হলে উম্মাহর প্রতিটি যুবককে ঈমানের আগুনে জ্বলে উঠতে হয়।
 
ওজু করতে গিয়ে পানির স্পর্শে শরীরটা শিউরে উঠল। এই কনকনে ঠান্ডায় ওজু করাটা একটা জিহাদ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "আমি কি তোমাদের এমন কাজের কথা বলব না, যাতে আল্লাহ পাপ মোচন করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন?" সাহাবীরা বললেন, "অবশ্যই, ইয়া রাসুলাল্লাহ!" তিনি বললেন, "কষ্টের সময় পূর্ণরূপে ওজু করা..."
 
মসজিদে যাওয়ার পথে আজ কুয়াশা খুব ঘন। হাত দেড়েক সামনের কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হলো, আমরা দুনিয়ার জীবনেও তো এমন কুয়াশায় আটকা পড়ে আছি। আমরা ভবিষ্যৎ জানি না, আমরা গন্তব্য স্পষ্ট দেখি না। শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা (তাওয়াক্কুল) করে পা ফেলি। এই যে আমি হাঁটছি, আমি জানি না সামনের গর্তে পড়ব কি না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি—মসজিদের মিনার থেকে যে 'হাইয়্যা আলাল ফালাহ' (এসো কল্যাণের দিকে) ডাক আসছে, সেই ডাক আমাকে পথ দেখাবে।
 
মসজিদে আজ মুসল্লি কিছুটা বেড়েছে। আমি প্রথম কাতারে জায়গা পেলাম। আমার ডান পাশে তানভীর। ও আমার আগেই এসেছে। ওর পরনে সেই লেদার জ্যাকেটটা নেই, সাধারণ একটা সোয়েটার। কিন্তু ওর চেহারায় যে নূর বা দ্যুতি দেখতে পাচ্ছি, তা কোনো দামী জ্যাকেট দিতে পারে না। সেজদায় গিয়ে ও যখন ফুপিয়ে উঠল, তখন আমার মনে হলো—এই চোখের পানিই তো সেই অস্ত্র, যা পরমাণু বোমার চেয়েও শক্তিশালী। আমরা এই অস্ত্রটা ব্যবহার করতে ভুলে গেছি।
 
নামাজ শেষে ইমাম সাহেব আজ সূরা আল-ইমরানের একটা আয়াত শোনালেন।
 
"তোমরা হীনবল হয়ো না এবং চিন্তিত হয়ো না; তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও।"
 
আয়াতটা শোনার পর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। আল্লাহ শর্ত দিয়েছেন—"যদি তোমরা মুমিন হও"। আমরা কি আসলেই মুমিন হতে পেরেছি? নাকি আমরা শুধু জন্মসূত্রে মুসলিম? আইডি কার্ডে ধর্ম 'ইসলাম', কিন্তু জীবনাচরণে 'বস্তুবাদ'। আমাদের বিজয় আটকে আছে আমাদের ঈমানের দুর্বলতার কারণে। গাজা মার খাচ্ছে না, মার খাচ্ছি আমরা। আমাদের গাফিলতি মার খাচ্ছে।
 
মসজিদ থেকে বেরিয়ে আমরা তিনজন—আমি, তানভীর আর সাকিব—চা খেতে দাঁড়ালাম। টং দোকানের চা। মাটির কাপ। ধোঁয়া উঠছে।
 
সাকিব বলল, "ভাই, কাল রাতে একটা নিউজ দেখলাম। গাজায় নাকি এখন পশু খাদ্য দিয়ে রুটি বানাচ্ছে। আর আমরা কাল রাতে রেস্টুরেন্টে গিয়ে মেনু কার্ড দেখে কনফিউজড ছিলাম—বিরিয়ানি খাব নাকি নান-গ্রিল। আমার গলার নিচে খাবার নামছিল না।"
 
তানভীর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, "শুধু আফসোস করে লাভ নেই। আমাদের 'প্রজেক্ট রুহানিয়া'র ফান্ডে গত সপ্তাহে ভালো টাকা জমেছে। অফিসের অনেকেই এখন টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে দিচ্ছে। রিফাত তো ওর বাইকটা বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবছে। ও নাকি পাবলিক বাসে যাতায়াত করবে।"
 
আমি চমকে উঠলাম। "রিফাত বাইক বিক্রি করবে? ও তো বাইক ছাড়া এক কদমও নড়ে না!"
 
"ও বলেছে, 'গাজার মানুষ যদি মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বর্ডার পার হতে পারে, আমি কি বাসে চড়তে পারব না? আমার বাইকের তেলের টাকাটা যদি কোনো বাচ্চার দুধের জন্য কাজে লাগে, সেটাই লাভ'।"
 
সুবহানাল্লাহ! হিদায়াত কার দিলে কখন কীভাবে আসে, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। আমরা মানুষকে জাজ করি, কিন্তু আল্লাহ মানুষের অন্তর দেখেন। রিফাতকে আমরা 'মডার্ন' বলে অবজ্ঞা করতাম, আর আজ সে ত্যাগের এমন নজির স্থাপন করছে যা আমাদের লজ্জা দেয়।
 
সকাল দশটা। অফিস। কাজের চাপ প্রচুর। কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের দাওয়াহর কাজ চলছে। তবে বাধা আসবেই। এটাই নিয়ম। লাঞ্চ আওয়ারে আমাদের বস, মি. চৌধুরী আমাকে কেবিনে ডাকলেন। তিনি বেশ রাগী মানুষ। ধর্ম-কর্মের ধার ধারেন না।
 
"শুনলাম তোমরা নাকি অফিসে একটা গ্রুপ করেছ? লাঞ্চ টাইমে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করো? ফান্ড কালেকশন করছ?" চৌধুরী সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন।
 
আমি বিনীতভাবে বললাম, "স্যার, আমরা লাঞ্চ টাইমে আড্ডা না দিয়ে একটু পড়াশোনা করি। নিজেদের নৈতিক উন্নয়ন নিয়ে কথা বলি। আর ফান্ডটা আমরা স্বেচ্ছায় দিচ্ছি, গরিবদের শীতবস্ত্র দেওয়ার জন্য।"
 
"লিসেন, অফিস হলো কাজের জায়গা। এখানে ওসব মোল্লাতন্ত্র চলবে না। ফান্ড রেইজিং বন্ধ করো। আর লাঞ্চ টাইমে এসব মিটিং ফিসফিসানি—এগুলো পরিবেশ নষ্ট করে। বি প্রফেশনাল।"
 
আমার বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠল। ইচ্ছে হলো মুখের ওপর বলে দিই—স্যার, এই প্রফেশনালিজম কি আমাদের কবরে বাঁচাবে? কিন্তু আমি নিজেকে সামলালাম। মুসা (আ.)-কে আল্লাহ ফেরাউনের কাছে পাঠানোর সময় বলেছিলেন—"তার সাথে নরম ভাষায় কথা বলো।"
 
আমি শান্তভাবে বললাম, "স্যার, আমরা অফিসের কোনো রুলস ব্রেক করছি না। আমরা কাজের সময়ে কাজই করি। বরং এই আলোচনার ফলে আমাদের কলিগদের সততা বেড়েছে, কাজের প্রতি ফোকাস বেড়েছে। আপনি চাইলে একদিন আমাদের সাথে বসতে পারেন। আর ফান্ডটা সম্পূর্ণ মানবিক। মানবতার সেবা করা কি আনপ্রফেশনাল?"
 
চৌধুরী সাহেব চুপ করে রইলেন। তিনি হয়তো আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছিলেন না। সত্যের একটা তেজ আছে। তিনি ফাইলটা বন্ধ করে বললেন, "আচ্ছা, যাও। তবে কাজের যেন ক্ষতি না হয়।"
 
কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। এটা একটা ছোট বিজয়। শয়তান চেয়েছিল আমাকে রাগিয়ে দিতে, কিন্তু সবর বা ধৈর্যের ঢাল আমাকে বাঁচিয়ে দিল।
 
বিকেলে তানভীর আর আমি গেলাম শহরের এক বস্তিতে। আমাদের 'প্রজেক্ট রুহানিয়া'র প্রথম কার্যক্রম। আমরা কোনো দামী কম্বল কিনিনি। আমরা কিনেছি মোটা কাপড়ের চাদর আর সোয়েটার। কম টাকায় বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য।
 
বস্তির সরু গলি। নর্দমার গন্ধ। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। এখানেই মানুষ থাকে। এদের দেখলেই বোঝা যায়, দুনিয়াটা আসলে কত তুচ্ছ। আমরা এসি রুমে বসে ডিপ্রেশনে ভুগি, আর এরা পলিথিনের ছাদের নিচে হাসিমুখে দিন পার করে।
এক বৃদ্ধা মহিলাকে চাদরটা দিতেই তিনি আমার হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। "বাবা, আল্লাহ তোমারে বাঁচায়ে রাখুক। তিন দিন ধইরা শীতে ঠকঠক কইরা কাঁপতাছি। কেউ ফিরেও চায় না।"
 
আমি তার হাতটা ধরলাম। খসখসে চামড়া। ঠিক যেন আমার দাদির হাত। আমি বললাম, "খালাম্মা, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আর দোয়া করবেন ফিলিস্তিনের মানুষগুলোর জন্য। তাদের অবস্থা আপনাদের চেয়েও খারাপ।"
 
তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। "টিভিতে দেখি বাবা। ওই বাচ্চাগুলার লাইগা কলিজাটা ফাইটা যায়। আমি তো গরিব, টাকা দিতে পারি না। কিন্তু প্রতি ওয়াক্ত নামাজে হাত তুইলা ওদের লাইগা বদদোয়া করি—যারা ওদের মারতাছে, আল্লাহ যেন ওদের ধ্বংস করে।"
 
এই বৃদ্ধার দোয়া! আরশ কাঁপানো দোয়া। এই দোয়াই তো ইসরায়েলের আয়রন ডোমকে অকেজো করে দেবে ইনশাআল্লাহ। আমরা মনে করি টাকা আর অস্ত্রই শক্তি। কিন্তু মজলুমের দোয়া যে কত বড় শক্তি, তা আমরা ভুলে যাই।
 
কাজ শেষে যখন ফিরছি, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাগরিবের আজান দিচ্ছে। আমরা রাস্তার ধারের এক ছোট মসজিদে নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে তানভীর বলল, "দোস্ত, একটা অদ্ভুত শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে। এই যে দেওয়া, এই যে মানুষের হাসি দেখা—এর চেয়ে বড় নেশা আর কিছু নেই।"
 
বাসায় ফিরতেই দেখি রাফিয়া সোফায় বসে আছে। চোখমুখ লাল। কাঁদছে।
 
"কী হয়েছে রে?" আমি কাছে গিয়ে বসলাম।
 
রাফিয়া চোখ মুছে বলল, "ভাইয়া, আজ ভার্সিটিতে প্রেজেন্টেশন ছিল। আমি হিজাব পরে গিয়েছিলাম। আমার ফ্রেন্ডরা... ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে। একজন বলল, 'কিরে, তুই তো খ্যাত হয়ে গেছিস। এটা কি আফগানিস্তান পেয়েছিস?' ম্যামও আমাকে বললেন, 'নেক্সট টাইমে স্মার্ট হয়ে আসবে'।"
 
আমার রক্ত গরম হয়ে গেল। কিন্তু আমি নিজেকে শান্ত রাখলাম। রাফিয়ার মাথায় হাত রাখলাম।
 
"শোন বোন, হীরা যখন কয়লার খনিতে থাকে, তখন কয়লাগুলো হীরাকে দেখে হাসে। তারা ভাবে হীরাটা কালো হয়ে গেছে। কিন্তু জহুরি জানে হীরার দাম কত। তুই হীরা। ওরা কয়লা। ওদের কথায় তোর দাম কমবে না।"
 
"কিন্তু ভাইয়া, খারাপ লাগে। আমি তো ওদের মতোই ছিলাম। হঠাৎ করে আমি 'অন্যরকম' হয়ে গেলাম কেন?"
 
"কারণ তুই 'গুরাবা' বা অপরিচিতদের দলে নাম লিখিয়েছিস। রাসুল (সা.) বলেছেন, 'ইসলাম শুরু হয়েছিল অপরিচিত অবস্থায়, এবং অচিরেই তা আবার অপরিচিত অবস্থায় ফিরে যাবে। তাই সুসংবাদ সেই অপরিচিতদের জন্য।' ওরা তোকে আনস্মার্ট বলবে, খ্যাত বলবে। কিন্তু আল্লাহ তোকে বলবেন—'আমার বান্দী'। কোনটা তোর চাই? ওদের বাহবা, নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টি?"
 
রাফিয়া আমার দিকে তাকাল। ওর চোখের পানি তখনো শুকায়নি, কিন্তু দৃষ্টিতে দৃঢ়তা ফিরে এসেছে। "আল্লাহর সন্তুষ্টি চাই ভাইয়া। ওরা যা ইচ্ছা বলুক। আমি আর হিজাব খুলব না। ফিলিস্তিনের মেয়েরা যদি বোমার মুখে হিজাব ধরে রাখতে পারে, আমি সামান্য টিটকারির ভয়ে হিজাব ছাড়ব?"
 
"সাবাস বোন! এটাই তো রুহানিয়া। এটাই তো আধ্যাত্মিক শক্তি। তুই আজ জিতে গেছিস।"
 
রাতে খাওয়ার টেবিলে মা বললেন, "আজ রান্না ভালো হয়নি। তরকারিতে লবণ কম হয়েছে।"
 
আমি বললাম, "মা, আলহামদুলিল্লাহ। গাজার মানুষ আজ হয়তো শুধুই পানি খেয়ে আছে। লবণের স্বাদ পাওয়ার ভাগ্যও তাদের নেই। আমাদের এই খাবার তো রাজকীয়।"
 
বাবা চুপচাপ খাচ্ছিলেন। তিনি সাধারণত কথা কম বলেন। হঠাৎ তিনি বললেন, "আমি ঠিক করেছি, আমাদের গ্রামের বাড়ির জমির কিছু অংশ বিক্রি করে দেব। ওই টাকাটা আমি ফিলিস্তিন ফাণ্ডে দিতে চাই। আমার আর কতদিন? কিন্তু ওই টাকাটা যদি আখেরাতের ব্যাংকে জমা থাকে, তবে সেটাই লাভ।"
 
আমি অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালাম। এই মানুষটা সারাজীবন কত কষ্ট করে জমিটুকু আগলে রেখেছেন। আর আজ এক মুহূর্তের সিদ্ধান্তে সব দিয়ে দিতে চাইছেন!
 
আসলে ঈমানের স্বাদ যখন কেউ পেয়ে যায়, তখন দুনিয়ার মোহ তার কাছে মাকড়সার জালের মতো ঠুনকো মনে হয়।
 
রাতে শুতে যাওয়ার আগে ডায়েরিটা খুললাম। একটা কথা মনে পড়ল—"সূর্য ডোবার পর অন্ধকার আসবেই, কিন্তু মোমবাতি জ্বালানোর দায়িত্বটা আপনার।"
 
লিখলাম:
 
শিরোনাম: আমরা কি সত্যিই জাগছি?
 
"আজ আমার বোন কেঁদেছে। হিজাব পরার অপরাধে। আজ আমার বন্ধু তার শখের বাইক বেচতে চেয়েছে। আজ আমার বাবা তার শেষ সম্বল জমিটুকু দিতে চেয়েছেন।
 
এগুলো কি শুধুই আবেগ? না। এগুলো হলো জেগে ওঠার লক্ষণ। আমরা বুঝতে শুরু করেছি যে, এই পৃথিবীটা আমাদের আসল বাড়ি নয়। আমরা এখানে প্রবাসী। আর প্রবাসীরা কখনো বিদেশের মাটিতে প্রাসাদ বানায় না, তারা দেশে টাকা পাঠায়। আমাদের দেশ হলো জান্নাত। আমরা এখন জান্নাতে কারেন্সি পাঠাচ্ছি।
 
ওরা আমাদের মারছে, আমাদের অপমান করছে। কিন্তু ওরা জানে না, ওরা যত আঘাত করবে, আমরা তত বেশি খাঁটি হবো। লোহাকে আগুনে পোড়ালে তা ইস্পাত হয়। আমাদের ঈমান এখন ইস্পাত হওয়ার পথে।
 
শীতের রাত। বাইরে কুকুর ডাকছে। কিন্তু আমার কানে বাজছে বদরের যুদ্ধের দামামা। আমার কানে বাজছে সালাউদ্দিন আইয়ুবীর ঘোড়ার খুরের শব্দ।
 
আমি একা নই। আমার সাথে আছে তানভীর, সাকিব, রিফাত, রাফিয়া, বাবা-মা। আমরা একটা কাফেলা। এই কাফেলা থামবে না। গন্তব্য হয়তো অনেক দূর, কিন্তু আমরা হাঁটা শুরু করেছি। আর যে হাঁটে, সে একদিন পৌঁছাবেই।"
 
কলমটা রেখে দিলাম। জানালার পর্দাটা সরিয়ে আকাশ দেখলাম। আজ আকাশ পরিষ্কার। অসংখ্য তারা। ঠিক যেন শহিদদের রুহ। তারা আমাদের দেখছে। তারা আমাদের ডাকছে।
 
"ভয় পেয়ো না হে মুসাফির, রাত তো হবেই পার,
ঈমান তোমার বুকের ভেতর, জ্বলন্ত এক ধার।
ছিঁড়বে শিকল, ভাঙবে কারা, দেখবে নতুন দিন,
শোধ হবে আজ রক্তে লেখা হাজারো সেই ঋণ।"
 
বিছানায় শুলাম। আজ আর ফ্লোরে নয়, বিছানাতেই শুলাম। কিন্তু শরীরটা বিছানায় থাকলেও মনটা পড়ে আছে আল-আকসার চত্বরে। আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি—আমি সেখানে নামাজ পড়ছি। আমার পাশে গাজার সেই শিশুটি, যার হাতে এখন আর ছেঁড়া কম্বল নেই, আছে বিজয়ের পতাকা।
 
ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু এই ঘুম গাফিলতির ঘুম নয়। এই ঘুম নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতির ঘুম। আগামী কাল শুক্রবার। জুমার দিন। নতুন পরিকল্পনা, নতুন উদ্যম।
 
রুহানিয়া কোনো গল্প নয়। এটা একটা লাইফস্টাইল। এটা একটা যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে আমরা হারব না ইনশাআল্লাহ। কারণ আমাদের স্লোগান—"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ"।
 
[রুহানিয়া]
[৬]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Send as a message
Share on my page
Share in the group
Translation is not possible.
মাঘের শেষ দিকে হুট করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। অসময়ের বৃষ্টি। শীতের মধ্যে এই বৃষ্টি গরিবের জন্য আজাব, আর ধনীর জন্য রোমান্টিসিজম। অফিসের গ্লাস ওয়ালের ওপাশে ঝাপসা শহরটার দিকে তাকিয়ে আছি। নিচে রাস্তায় ছাতা মাথায় মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা। কাদা-পানির ছপছপ শব্দ এখান থেকে শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে। আমার সহকর্মী জাহিদ ভাই গরম কফির মগ হাতে পাশে এসে দাঁড়ালেন।
 
"কি ওয়েদার মাইরি! আজ খিচুড়ি আর গরুর মাংস হলে জমত, তাই না?" জাহিদ ভাই বেশ আয়েশ করে চুমুক দিলেন কফিতে।
 
আমি তার দিকে তাকালাম। এই মানুষটা খারাপ না। কিন্তু তার জগৎটা শুধুই পেট আর পিঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তার কাছে বৃষ্টির মানে খিচুড়ি, আর শীতের মানে বারবিকিউ পার্টি। আমি মৃদু হেসে বললাম, "জাহিদ ভাই, এই বৃষ্টিতে ফুটপাতের মানুষগুলোর কথা ভাবছেন? ওদের তো পলিথিন টানানোরও জায়গা নেই।"
 
জাহিদ ভাই একটু অপ্রস্তুত হলেন। "আরে ধুর, তুমি সবসময় এত নেগেটিভ ভাবো কেন? ওদের অভ্যাস আছে। সরকার দেখবে ওদের। তুমি কফি খাবে?"
 
"না ভাই, রোজা আছি।"
 
জাহিদ ভাই চোখ বড় বড় করে তাকালেন। "আজ তো সোমবার না, বৃহস্পতিবারও না। হঠাৎ রোজা?"
 
আমি জানালা দিয়ে বাইরের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, "এমনিই। একটু ক্ষুধার কষ্টটা অনুভব করার চেষ্টা করছি। গাজার মানুষগুলো তো ঘাস খেয়ে রোজা রাখছে, আর আমি সেহেরিতে ভাত খেয়েও তৃপ্তি পাই না। তাই ভাবলাম, নফসটাকে একটু শাসন করি।"
 
জাহিদ ভাই চুপ করে গেলেন। তিনি হয়তো আমাকে 'মৌলবাদী' বা 'আতেল' ভাবছেন। ভাবুন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সাহাবীরা যখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তখন মক্কার লোকেরা তাদের 'পাগল' বলত। আজ আমরা যদি সেই পাগলামির ছিটেফোঁটাও অর্জন করতে পারি, তবে সেটাই সফলতা।
 
লাঞ্চ ব্রেক। আজ আমাদের সেই 'স্টাডি সার্কেলের' প্রথম বসা। তানভীর কনফারেন্স রুমের একটা কোণা ম্যানেজ করেছে। ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কেউ আসবে কি না। তানভীর, সাকিব আর আমি—আমরা তিনজন তো আছিই। কিন্তু অবাক করে দিয়ে দেখলাম, আরও চারজন কলিগ এসে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে একজন রিফাত। অফিসের সবচেয়ে 'মডার্ন' ছেলে। কানে ইয়ারপড, হাতে ট্যাটু, আর মুখে সবসময় লেটেস্ট ওয়েব সিরিজ নিয়ে আলোচনা। ও এখানে কেন? মজা নিতে এসেছে?
 
সবাই গোল হয়ে বসলাম। টেবিলের মাঝখানে কোনো খাবার নেই। শুধু একটা কুরআন শরীফ আর কয়েকটা পানির বোতল। পরিবেশটা বেশ গম্ভীর। তানভীর আমাকে ইশারা করল শুরু করার জন্য। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। আমি তো কোনো বক্তা নই। আমি তো নিজেই একজন পথহারা মুসাফির।
 
"বিসমিল্লাহ," বলে শুরু করলাম। "ভাইয়েরা, আমরা এখানে কোনো ওয়াজ মাহফিল করতে বসিনি। আমরা এখানে বসেছি নিজেদের আয়নায় দেখার জন্য। আমরা সবাই মুসলিম, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমাদের ইসলামের দৌড় কতদূর? জুমার নামাজ আর ঈদের কোলাকুলি? নাকি তার চেয়েও গভীরে?"
 
রিফাত হঠাৎ হাত তুলল। ওর মুখে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসি। "ব্রাদার, একটা প্রশ্ন ছিল। এই যে আমরা এখানে বসেছি, গাজা নিয়ে বা ধর্ম নিয়ে কথা বলছি, এতে কি প্র্যাকটিক্যালি কোনো লাভ হবে? মানে, আমাদের জিডিপি বাড়বে? নাকি ইসরায়েল যুদ্ধ থামাবে? আমরা তো ইমোশনাল জাতি, হুজুগে মাতি বেশি। কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছে না।"
 
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল। তানভীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি ওকে থামালাম। এই প্রশ্নটা রিফাতের একার না, এটা আমাদের পুরো প্রজন্মের প্রশ্ন। আমরা সবকিছুকে 'লাভ-ক্ষতি'র দাঁড়িপাল্লায় মাপি।
 
আমি শান্ত গলায় বললাম, "রিফাত, তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা ইমোশনাল। কিন্তু ইমোশন ছাড়া মানুষ আর রোবটের মধ্যে তফাৎ কী? আর কাজের কথা বলছ? আচ্ছা, ধরো তোমার মা খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে বাঁচার আশা নেই। তুমি কি তখন ওষুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেবে? তুমি কি বলবে—'প্র্যাকটিক্যালি তো কোনো লাভ নেই, মা তো মরবেই, শুধু শুধু টাকা খরচ করে কী লাভ?'"
 
রিফাত চুপ করে গেল। ওর হাসিটা মিলিয়ে গেছে।
 
আমি বলে চললাম, "তুমি তা করবে না। তুমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করবে। কেন? কারণ ওটা তোমার মা। তোমার অস্তিত্বের শেকড়। গাজা আমাদের মায়ের মতো, রিফাত। উম্মাহ মানে মা। মুসলিম উম্মাহ একটা মায়ের মতো। সেই মায়ের শরীরে যখন পচন ধরে, তখন সন্তান হিসেবে আমরা যদি বলি 'লাভ কী', তবে আমরা কুলাঙ্গার সন্তান। আমরা এখানে বসেছি ইসরায়েলকে থামানোর জন্য নয়, আমরা এখানে বসেছি আল্লাহর কাছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে—'হে আল্লাহ, আমাদের হাতে ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু আমাদের দিলে ব্যথা ছিল। আমরা উদাসীন ছিলাম না'।"
 
রিফাত মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি কুরআনের পাতা উল্টালাম। সূরা আত-তওবা, আয়াত ২৪। আয়াতটা পড়ার আগে বললাম, "আমরা যারা ব্র্যান্ডের পেছনের ঘুরি, ক্যারিয়ার নিয়ে পাগল, তাদের জন্য আল্লাহ একটা অ্যালার্ম দিয়েছেন। শুনবেন?"
 
তিলাওয়াত করলাম অর্থসহ:
 
"বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় করো এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করো—আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর নির্দেশ (আযাব) আসা পর্যন্ত।"
 
পড়তে পড়তে আমার কণ্ঠ ধরে এল। "ভাইয়েরা, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমাদের কাছে আজ কোনটা প্রিয়? ফজরের নামাজের চেয়ে কি ঘুমের আরাম প্রিয় নয়? আল্লাহর হুকুমের চেয়ে কি বসের হুকুম প্রিয় নয়? আমরা তো সেই জাতি, যারা মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-এর উত্তরসূরি। মুসআব (রা.) মক্কার সবচেয়ে হ্যান্ডসাম যুবক ছিলেন। সবচেয়ে দামী সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। সেই মুসআব যখন ইসলাম কবুল করলেন, মা তাকে ত্যাজ্য করল, সম্পদ কেড়ে নিল। উহুদের যুদ্ধে যখন তিনি শহিদ হলেন, তখন তার কাফনের কাপড় এত ছোট ছিল যে, মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যেত, আর পা ঢাকলে মাথা। রাসুল (সা.) কেঁদে বলেছিলেন—'মুসআব! আজ তোমার এই অবস্থা! অথচ মক্কায় তোমার মতো বিলাসী কেউ ছিল না।' কেন তিনি সব ছাড়লেন? কার জন্য?"
 
ঘরটা একদম নিস্তব্ধ। শুধু বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে। হঠাৎ দেখলাম সাকিবের চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে গেছে। সে চশমা খুলে চোখ মুছল। রিফাত, সেই উদ্ধত রিফাত, তার হাতের ট্যাটুটা আড়াল করার চেষ্টা করছে জামার হাতা টেনে। হয়তো তার মনে হচ্ছে, এই চামড়াটা আল্লাহর আমানত, আর সে তাতে কী একেছে!
 
তানভীর বলল, "আমরা অনেক ভুল করেছি। অনেক সময় নষ্ট করেছি। কিন্তু আর না। আজ থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করব—আমাদের আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ, হোক সেটা ৫ শতাংশ বা ১০ শতাংশ, আমরা মানুষের কল্যাণে দেব। আর আমরা নিজেদের জানব। পড়ব। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন আমরা এই স্টাডি সার্কেল চালু রাখব।"
 
সবাই মাথা নাড়ল। রিফাত বলল, "আমি... আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমার স্যালারির অর্ধেকটা আমি এই মাসে ডোনেট করতে চাই। কিন্তু আমি জানি না কোথায় দিতে হবে। তোমরা কি হেল্প করবে?"
 
আমার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! পাথরের বুক চিরেও ঝরনাধারা বের হতে পারে! রিফাত, যাকে আমি ভেবেছিলাম সবচেয়ে বড় বাধা, সে আজ সবচেয়ে বড় ত্যাগের ঘোষণা দিল।
 
মিটিং শেষ হলো। সবাই যখন বের হচ্ছে, তখন মনে হলো ওদের কাঁধের ভারটা যেন কিছুটা কমে গেছে। অথবা হয়তো ভারটা বেড়েছে—দায়িত্বের ভার। কিন্তু এই ভার বহন করার মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ আছে।
 
বিকেলে অফিস থেকে বের হলাম। বৃষ্টি থামেনি। গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে। আমার ছাতা নেই। হুডিটা মাথায় টেনে নিলাম। রাস্তায় পানি জমে গেছে। রিকশা পাওয়া দুষ্কর। হাঁটতে শুরু করলাম।
 
হাঁটতে হাঁটতে পকেটে হাত দিলাম। মোবাইলটা বের করলাম। গাজার আপডেট দেখার সাহস হচ্ছে না। তবুও দেখলাম। জাবালিয়া ক্যাম্পে হামলা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে শত শত মানুষ। একটা ভিডিওতে দেখলাম, বৃষ্টির পানিতে তাঁবু ভেসে গেছে। কাদামাটিতে বসে এক শিশু কাঁদছে। তার গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই।
 
আমার গায়ের হুডিটা যেন আগুনের মতো গরম মনে হতে লাগল। আমি এই শহরে, এই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে বাড়ি ফিরব, গরম কফি খাব, লেপের নিচে ঘুমাব। আর ওই শিশুটা?
 
হঠাৎ মনে পড়ল, আমার বাসায় একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা পড়ে আছে। শখ করে কিনেছিলাম ফটোগ্রাফি করব বলে। গত দুই বছরে ওটা আলমারি থেকে বের করা হয়নি। লেন্সসহ ওটার দাম অন্তত ষাট-সত্তর হাজার টাকা হবে। ওটা দিয়ে আমি কী করব? প্রকৃতির ছবি তুলব? মানুষের হাসিমুখের ছবি তুলব? যেখানে আমার উম্মাহর চেহারা রক্তে মাখা, সেখানে আমি ফুলের ছবি তোলার বিলাসিতা করি কী করে?
 
সিদ্ধান্ত নিলাম। ওটা বেচে দেব। এখনই।
 
আমি উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করলাম। ইলেকট্রনিক্স মার্কেটের দিকে। বৃষ্টির ঝাপটা মুখে লাগছে। মনে হচ্ছে এই বৃষ্টি আমার গুনাহগুলো ধুয়ে দিচ্ছে। আমি জানি, ক্যামেরা বিক্রির টাকা দিয়ে গাজা স্বাধীন হবে না। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে যদি একটা তেরপল কেনা যায়, একটা কম্বল কেনা যায়, তবে হাশরের ময়দানে আমি ওই ক্যামেরাটা সাক্ষী হিসেবে পাব না, পাব ওই কম্বলটা।
 
দোকানে গেলাম। পরিচিত এক বড় ভাই আছেন, যিনি সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যামেরা কেনেন। আমাকে দেখে অবাক হলেন। "কি ভাই, ভিজে একাকার অবস্থা! ক্যামেরা বিক্রি করবেন? নতুন মডেল নেবেন নাকি?"
 
আমি ক্যামেরাটা কাউন্টারে রাখলাম। "না ভাই, নতুন কিছু নেব না। শুধু বিক্রি করব। ইমার্জেন্সি টাকা দরকার।"
 
তিনি ক্যামেরাটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। "কন্ডিশন তো একদম ফ্রেশ। পঁয়তাল্লিশ হাজার দিতে পারব। এর বেশি হবে না ভাই।"
 
আমি দরদাম করলাম না। বললাম, "আলহামদুলিল্লাহ। দিন।"
 
টাকাটা হাতে নিয়ে যখন দোকান থেকে বের হলাম, তখন এক অদ্ভুত হালকাবোধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে পিঠের ওপর থেকে বিশাল এক বোঝা নেমে গেল। আমার প্রিয় শখ, আমার প্যাশন—সবকিছু আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করে দেওয়ার যে স্বাদ, তা কোনো বিরিয়ানি বা ব্র্যান্ডের পোশাকে নেই।
 
বাসায় ফেরার পথে তানভীরকে ফোন দিলাম।
 
"দোস্ত, আমার ক্যামেরাটা বেচে দিলাম।"
 
তানভীর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, "আল্লাহ কবুল করুন দোস্ত। আল্লাহ তোর এই ব্যবসার উত্তম প্রতিদান দিন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন।"
 
বাসায় ঢুকলাম। মা জায়নামাজে বসে তসবিহ পড়ছিলেন। আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে বললেন, "কিরে, ছাতা নিসনি? জ্বর আসবে তো।"
 
আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। ভেজা মাথাটা মায়ের কোলে রাখলাম। মা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। এই স্পর্শটা কত শান্তির! গাজার কত সন্তান আজ এই স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। কত মা আজ সন্তানের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
 
"মা," আমি ফিসফিস করে বললাম।
 
"বল বাবা।"
 
"আমাদের কি অনেক বেশি দরকার? বাঁচার জন্য?"
 
মা হাসলেন। "না রে পাগল। বাঁচার জন্য তো অল্পই দরকার। আমরা তো বাঁচার জন্য খাই না, খাওয়ার জন্য বাঁচি—তাই এত দরকার হয়।"
 
"মা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার জমানো টাকা আর ক্যামেরা বিক্রির টাকাটা আমি ফিলিস্তিনে পাঠাতে চাই। আমাদের পরিচিত এক এনজিওর ভাই আছেন, যিনি সরাসরি বর্ডারে কাজ করছেন। আমি কি দেব?"
 
মা আমার মুখটা তুলে ধরলেন। তার চোখে পানি, কিন্তু ঠোঁটে হাসি। "তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস? ওটা তো আল্লাহর মাল। তুই তো শুধু আমানতদার। দিয়ে দে বাবা। সব দিয়ে দে। আল্লাহ যদি আমাদের রিজিকে বরকত দেন, তবে ডাল-ভাতেই পেট ভরবে। আর যদি বরকত না থাকে, তবে পোলাও খেয়েও শান্তি পাবি না।"
 
মায়ের কথা শুনে আমার ভেতরটা শান্ত হয়ে গেল। মায়েরা আসলে অনেক বড় আলেম। তারা কিতাব না পড়েও ইসলামের নির্যাসটুকু বুঝে ফেলেন।
 
রাতে ইফতারের সময় (নফল রোজার ইফতার) সামান্য খেজুর আর পানি দিয়ে রোজা ভাঙলাম। রাফিয়া আমার জন্য শরবত বানিয়ে এনেছে। ও ইদানীং খুব চুপচাপ। ওর মোবাইলে এখন আর হিন্দি গানের রিলস বাজে না। ও এখন ফিলিস্তিনের ইতিহাস পড়ছে। গতকাল ও আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, "ভাইয়া, সালাউদ্দিন আইয়ুবী কি সত্যিই একা জেরুজালেম জয় করেছিলেন?" আমি বলেছিলাম, "একা না বোন, তার সাথে ছিল একদল রুহানি সৈনিক, যারা রাতের আঁধারে জায়নামাজ ভেজাত, আর দিনের আলোয় ঘোড়া ছোটাত।"
 
রাফিয়া তখন বলেছিল, "আমিও কি সেই সৈনিক হতে পারি ভাইয়া? আমার তো ঘোড়া নেই, তলোয়ার নেই।"
 
আমি বলেছিলাম, "তোর ঘোড়া নেই, কিন্তু তোর লজ্জা আছে, তোর পর্দা আছে। তোর তলোয়ার নেই, কিন্তু তোর কলম আছে, তোর মেধা আছে। তুই তোর জায়গা থেকে যুদ্ধ কর।"
 
রাফিয়া আজ হিজাব পরে আমার সামনে এসেছে। ঠিকমতো বাঁধতে পারেনি, এলোমেলো হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে ওকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রাজকন্যা মনে হচ্ছে। এই তো বিজয়। এই তো বিপ্লব।
 
রাতের খাবার শেষে আমি আমার ডায়েরিটা খুললাম। একটা কথা মনে পড়লো, "গল্পগুলো অন্যরকম হতে পারত।" হ্যাঁ, আমাদের গল্পগুলো অন্যরকম হতে পারত। আমরা শুধুই ভোগবাদী প্রাণী হয়ে মরতে পারতাম। কিন্তু আল্লাহ আমাদের দয়া করেছেন। তিনি আমাদের জাগিয়েছেন।
 
আমি লিখলাম:
 
শিরোনাম: একটি ক্যামেরা ও কিছু ছেঁড়া স্বপ্ন
 
"আজ আমি আমার শখের লেন্সটা বিক্রি করে দিলাম। লেন্সটা দিয়ে জুম করলে অনেক দূরের জিনিস কাছে দেখা যেত। কিন্তু আজ আমি লেন্স ছাড়াই অনেক দূরের একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি—জান্নাতের দরজায় কিছু ধুলোমাখা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গায়ে দামী জ্যাকেট নেই, তাদের পায়ে ব্র্যান্ডের জুতো নেই। কিন্তু তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও উজ্জ্বল। ফেরেশতারা তাদের স্যালুট দিচ্ছে।
 
আমি কি সেই লাইনে দাঁড়াতে পারব? আমার আমলনামায় তো শুধুই গাফিলতি। কিন্তু হে আল্লাহ! তুমি তো অন্তর্যামী। তুমি জানো, আজ এই শখের বস্তুটা বিক্রি করার সময় আমার একটুও কষ্ট হয়নি। বরং মনে হয়েছে, আমি একটা জান্নাতের টিকেট বুকিং দিলাম।
 
শীত এখনো আছে। বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু আমার রুহের ভেতরে এখন বসন্তের বাতাস। কারণ আমি বুঝতে শিখেছি—দেওয়ার নামই সুখ, আঁকড়ে ধরার নাম যন্ত্রণা।"
 
লেখা শেষ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে একটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। ওটা কি ধ্রুবতারা? নাকি ওটা গাজার কোনো এক শহিদি আত্মার আলো?
 
আমি জানি না। তবে এটুকু জানি, আমাদের এই ছোট ছোট ত্যাগগুলো বৃথা যাবে না। বিন্দু বিন্দু জল দিয়েই সিন্ধু হয়। আমরা হয়তো আবাবিল পাখির মতো ছোট, কিন্তু আমাদের পাথরগুলো যদি সঠিক লক্ষ্যে ছুড়তে পারি, তবে আধুনিক নমরুদদের পতন নিশ্চিত।
 
তানভীর, সাকিব, রিফাত, রাফিয়া, মা—আমরা সবাই এখন একটা অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা। রুহানিয়ার সুতো। এই সুতো ছিঁড়বে না ইনশাআল্লাহ।
 
বিছানায় যাওয়ার আগে আমি আমার পুরনো জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। কাল ফজরের নামাজে এই জ্যাকেট পরেই যাব। ইমাম সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে যখন 'আমিন' বলব, তখন যেন আমার আমিন ধ্বনি গাজার ধ্বংসস্তূপ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
 
"জেগেছে যুবক, জেগেছে প্রাণ,
শুনছি আবার বিজয়ের গান।
শখের খাঁচা ভেঙেছি আজ,
পরবো না আর মিথ্যে তাজ।
এক আল্লাহ, এক উম্মাহ,
ভয় কি আর? নেই তো ভয়!
রক্তে কেনা এই ঈমান,
আনবে ঠিকই বিশ্বজয়।"
 
[রুহানিয়া]
[৫]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Send as a message
Share on my page
Share in the group
Translation is not possible.
শুক্রবার। ছুটির দিন। কিন্তু মুমিনের জীবনে কি আসলে কোনো 'ছুটি' আছে? শয়তান তো কোনো দিন ছুটি নেয় না। সে শুক্রবারের অলস দুপুরে আমাদের চোখের পাতায় ঘুমের ভারী প্রলেপ লাগিয়ে দেয়, যাতে আমরা জুমার খুতবার সেই বজ্রকঠিন বার্তাগুলো শুনতে না পাই।
 
আজ কাজিন রেহানের বিয়ে। শহরের সবচেয়ে নামী কনভেনশন হলে আয়োজন। বাবা-মা জোর করেই পাঠালেন। আমার একদম ইচ্ছে ছিল না। যে সময়ে গাজার মায়েরা তাদের সন্তানদের শরীরের টুকরোগুলো পলিথিন ব্যাগে ভরছে, সেই সময়ে আমি কীভাবে গায়ে শেরওয়ানি চাপিয়ে বিরিয়ানির গন্ধে মাতোয়ারা হবো? কিন্তু সামাজিকতা। এই 'সামাজিকতা' শব্দটা আমাদের ধর্মের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আল্লাহকে নারাজ করতে রাজি, কিন্তু আত্মীয়-স্বজনকে নারাজ করতে পারি না। কী অদ্ভুত আমাদের প্রায়োরিটি!
 
কনভেনশন হলের গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আলোর ঝলকানি। যেন দিনের আলোকেও হার মানাবে। গেটের দুপাশে বিদেশি ফুলের তোড়া। অথচ এই ফুলগুলো কাল সকালেই ডাস্টবিনে জায়গা পাবে। ভেতরে ঢুকতেই এসির ঠান্ডা হাওয়া। বাইরে মাঘের শীত, ভেতরে কৃত্রিম শীত। হলভর্তি মানুষ। সবার গায়ে দামী দামী পোশাক। বেনারসি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস, স্যুট-কোট। রঙের মেলা। বাতাসে দামী পারফিউমের কড়া গন্ধ। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে হিন্দি গান।
 
আমি এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজেকে বড্ড বেমানান লাগছে। চারপাশের এই হাসিখুশি মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, আমি কি কোনো ভুল গ্রহে চলে এসেছি? নাকি আমি কোনো মানসিক রোগী, যে সবার মাঝে থেকেও একা?
 
আমার সামনেই বুফে টেবিল। খাবারের পাহাড়। খাসির লেগ রোস্ট, চিকেন ফ্রাই, কয়েক পদের মাছ, পোলাও, বিরিয়ানি। মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়া ভিড়। প্লেটে খাবার নেওয়ার প্রতিযোগিতা। একজন তার প্লেটে পাহাড় সমান খাবার নিচ্ছে। সে জানে সে এত খেতে পারবে না, তবুও নিচ্ছে। কারণ, 'টাকা দিয়েছি, উসুল করতে হবে'।
 
হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছবিটা। গতকাল রাতে ফেসবুকে দেখেছিলাম। উত্তর গাজার এক শিশু। হাড় জিরজিরে শরীর। চামড়াগুলো পাঁজরের সাথে লেগে আছে। তার সামনে একটা বাটিতে কিছু ঘাস সেদ্ধ করা। সে সেটাই খাচ্ছে। তার চোখে কোনো অভিযোগ নেই, আছে শুধু বাঁচার আকুতি।
 
আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হলো আমি এখনই বমি করে দেব। এই যে আমার সামনে প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে একজন হাসতে হাসতে অর্ধেকটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল—এই দৃশ্যটা আমার কাছে কোনো হরর মুভির চেয়েও ভয়ানক লাগল। আল্লাহ কি আমাদের ধরবেন না? অবশ্যই ধরবেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, "অতঃপর সেদিন (কিয়ামতের দিন) তোমাদেরকে অবশ্যই নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।"
 
এই যে অপচয়, এই যে রিজিকে লাথি মারা—এর হিসাব কি দিতে হবে না?
 
আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন এক দূর সম্পর্কের চাচা। গায়ে চকচকে মুজিব কোট। পান চিবুচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, "কিরে বাবা, মন খারাপ নাকি? বিয়েবাড়িতে এমন গোমড়ামুখা হয়ে আছিস কেন? কিছু খাচ্ছিস না?"
 
আমি ম্লান হাসলাম। বললাম, "না চাচা, খিদে নেই।"
 
"আরে, খিদে নেই বললেই হবে? পোলাওয়ের যা সেন্ট বের হয়েছে! শোন, জীবনটা এনজয় করতে হয়। এত ভাবলে চলে না। তোদের জেনারেশনের এই এক সমস্যা, সারাক্ষণ ডিপ্রেশনে থাকিস।"
 
আমি চাচাকে কী জবাব দেব? আমি কি তাকে বলব, চাচা, এটা ডিপ্রেশন নয়, এটা ঈমানের জ্বালা? রাসুলুল্লাহ (সা.) কি সাহাবীদের নিয়ে পেট পুরে খেতেন যখন মদিনার কোনো প্রান্তে কেউ না খেয়ে থাকত?
 
চাচা আবার বললেন, "শুনলাম তুই নাকি এখন খুব হুজুর হয়ে গেছিস? ভালো ভালো। তবে বাবা, বেশি ডিপে যাস না। ফ্যাসাদ তো আবার বাড়ছে। ইসলাম মানবি, কিন্তু ব্যালেন্স করে। এই যে আমরা নামাজও পড়ি, আবার সমাজও রক্ষা করি। এটাই তো স্মার্ট ইসলাম।"
 
'স্মার্ট ইসলাম'। শব্দটা শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেল। আমরা নিজেদের সুবিধামতো ইসলামকে মডিফাই করে নিয়েছি। যেখানে সুদ খাওয়া দরকার, সেখানে আমরা বলি 'ব্যাংক ইন্টারেস্ট'। যেখানে বেপর্দা হওয়া দরকার, সেখানে বলি 'কালচার'। আর যেখানে অপচয় করা দরকার, সেখানে বলি 'স্ট্যাটাস'। আমরা আল্লাহর হুকুমকে আমাদের লাইফস্টাইলের ছাঁচে ফেলে কেটেছেঁটে 'স্মার্ট' বানিয়েছি।
 
আমি চাচাকে বিনীতভাবে বললাম, "চাচা, ইসলাম তো ব্যালেন্সের ধর্মই। কিন্তু আমরা ব্যালেন্স করতে গিয়ে কি অন্যায়ের সাথে আপোষ করছি না? এই যে হাজার হাজার টাকার খাবার নষ্ট হচ্ছে, আর ওদিকে আমাদেরই মুসলিম ভাইরা না খেয়ে মরছে—এই ব্যালেন্সটা কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?"
 
চাচা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। "তুই আবার ওই ফিলিস্তিন ইস্যু টেনে আনছিস? আরে বাবা, ওটা ওদের পলিটিক্স। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। এর সাথে আমাদের বিয়েবাড়ির খাবারের কী সম্পর্ক? তুই কি এখান থেকে খাবার পাঠিয়ে দিবি গাজায়? বোকার মতো কথা বলিস না।"
 
"খাবার পাঠাতে পারব না চাচা, কিন্তু অন্তত খাবার নষ্ট না করার শিক্ষাটা তো নিতে পারি। রাসুল (সা.) খাবারের প্লেট চেটে খেতেন, যাতে এক দানা ভাতও নষ্ট না হয়। আর আমরা?"
 
চাচা বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বললেন, "মাথাটা গেছে ছেলেটার।"
 
হ্যাঁ, আমার মাথাটা গেছে। এবং আমি চাই এই মাথাটা এভাবেই 'গেছে' অবস্থায় থাকুক। কারণ সুস্থ মস্তিষ্কে এই অসুস্থ সমাজকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
 
আমি হল থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলাম। এখানে আওয়াজ একটু কম। আকাশের দিকে তাকালাম। শহরের ধোঁয়ায় আকাশটা ঝাপসা। নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হলো, আল্লাহ কি আমাদের ওপর রাগ করে আসমানের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন? আমরা দোয়া করি, কিন্তু দোয়া কবুল হয় না কেন? কারণ আমাদের পেটে হারাম, গায়ে হারাম, চিন্তায় হারাম।
 
পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট করল। তানভীরের মেসেজ। একটা ছবি পাঠিয়েছে। ছবিটা জুম করলাম। তানভীরের অফিসের ডেস্ক। সেখানে দুপুরের লাঞ্চের বক্স। কিন্তু বক্সে বিরিয়ানি বা ফাস্ট ফুড নেই। আছে সাধারণ ডাল-ভাত আর সবজি। নিচে ক্যাপশন লিখেছে—"আজ থেকে লাঞ্চের বাজেট ১০০ টাকা। বাকি ৩০০ টাকা 'প্রজেক্ট রুহানিয়া' ফান্ডে। দোস্ত, বিশ্বাস কর, ডাল-ভাতে যে এত তৃপ্তি, আগে বুঝিনি।"
 
আমার চোখ ভিজে এল। আলহামদুলিল্লাহ। এই তো পরিবর্তন। তানভীর কোনো বড় লেকচার শোনে না, ও শুধু নিজের বিবেককে প্রশ্ন করেছে। আর উত্তরটা পেয়ে গেছে। ছোট ছোট পরিবর্তনই একদিন পাহাড় সমান বিপ্লব আনবে।
 
বিয়েবাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। এই চাকচিক্য আমাকে শ্বাসরোধ করে মারছে। রাস্তায় নামলাম। রিকশা নিলাম না। হাঁটতে ইচ্ছে করছে। হাঁটার একটা গুণ হলো, এটা মাটির সাথে আমাদের সম্পর্ক মনে করিয়ে দেয়। আমরা এই মাটির তৈরি, আবার এই মাটিতেই মিশে যাব। মাঝখানের সময়টুকু শুধু অহংকার আর বড়াই।
 
হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে এসে বসলাম। শীতের রাত। পার্কে মানুষ নেই। শুধু দূরে কয়েকজন ছিন্নমূল মানুষ আগুন পোহাচ্ছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এদের জীবন কত কষ্টের। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, হয়তো এরাই আল্লাহর কাছে আমাদের চেয়ে বেশি প্রিয়। কারণ এদের হিসাব কম। এদের অপচয় করার মতো সম্পদ নেই। এদের অহংকার করার মতো স্ট্যাটাস নেই।
সাহাবী আবু যার গিফারী (রা.)-এর কথা মনে পড়ল। তিনি সম্পদ জমা করাকে ভয় পেতেন। তিনি বলতেন, "আমার বন্ধু (রাসুল সা.) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন আমার ওপরের দিকে না তাকাই (সম্পদে), বরং নিচের দিকে তাকাই।"
 
আমরা উল্টোটা করি। আমরা সবসময় দেখি কার গাড়িটা আমার চেয়ে বড়, কার ফ্ল্যাটটা আমার চেয়ে সুন্দর। এই প্রতিযোগিতাই আমাদের শেষ করে দিয়েছে।
 
হঠাৎ মনে হলো, আমি একা বসে আছি কেন? আমার তো এখন কাজ করার কথা। শুধু নিজে বুঝলে হবে না, অন্যকে বোঝাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? মানুষ তো শুনতে চায় না। মানুষ সত্যকে ভয় পায়।
 
আমি ফোনটা বের করে নোটপ্যাডে লিখতে শুরু করলাম। কারণ, কলম হলো মুমিনের তরবারি। যখন কথা বলার সুযোগ থাকে না, তখন লিখতে হয়।
 
শিরোনাম দিলাম: "আমরা কি রক্তের দাগ ঢাকতে পারফিউম মাখছি?"
 
লিখলাম:
 
"আজ একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। আলোর বন্যায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার চোখের সামনে ভাসছিল গাজার অন্ধকার গলিগুলো। আমরা প্লেটে খাবার নিয়ে নষ্ট করছি, আর ভাবছি আমরা খুব সভ্য। কিন্তু সভ্যতা কি পোশাকে থাকে? নাকি সভ্যতা থাকে বিবেকে?
 
প্রিয় ভাই ও বোন, আপনি যখন আপনার বাচ্চার জন্মদিনে হাজার হাজার টাকা খরচ করে কেক কাটেন, তখন কি একবারও মনে পড়ে ওই মায়ের কথা, যার বাচ্চার জন্ম হয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে? আমি বলছি না আনন্দ করবেন না। কিন্তু আনন্দের একটা সীমা থাকা উচিত। আমাদের আনন্দ যেন অন্যের বেদনার কারণ না হয়।
 
আমরা বয়কট করছি। কোক খাচ্ছি না, কেএফসিতে যাচ্ছি না। আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমরা কি আমাদের নফসকে বয়কট করতে পেরেছি? আমাদের অপচয়, আমাদের গীবত, আমাদের অহংকার—এগুলো কি ইসরায়েলি মিসাইলের চেয়ে কম ধ্বংসাত্মক?
 
আসুন, আজ রাতে একবার আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিজের ভেতরের মানুষটাকে প্রশ্ন করি—'আমি কি প্রস্তুত?' আজ যদি মালাকুল মউত আসেন, আমি কি হাসিমুখে যেতে পারব? নাকি বলব, 'আরেকটু সময় দাও, আমার তো এখনো অনেক শপিং বাকি'?"
 
লেখাটা ফেসবুকে পোস্ট করলাম। জানি না কয়জন পড়বে। হয়তো কেউ 'হা-হা' রিঅ্যাক্ট দেবে। কেউ হয়তো কমেন্টে লিখবে, 'বেশি বুঝেন কেন?' কিন্তু যদি একজন মানুষও, মাত্র একজন মানুষও লেখাটা পড়ে তার প্লেটের খাবারটা নষ্ট না করে, তবে সেটাই আমার সার্থকতা।
 
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। মা দরজা খুলে দিলেন। আমার হাতে খাবারের প্যাকেট নেই দেখে অবাক হলেন।
"বিয়েবাড়ি থেকে কিছু আনলি না? তোর ছোট বোনটা বিরিয়ানি পছন্দ করে।"
 
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চুলে পাক ধরেছে। এই মা আমাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছেন। কিন্তু মা-ও তো এই সমাজেরই অংশ। তিনিও চান ছেলে বড় চাকরি করবে, সমাজে নাম হবে।
 
বললাম, "মা, আজ থেকে আমরা একটু মিতব্যয়ী হবো। সপ্তাহে এক দিন আমরা মাছ-মাংস খাব না। শুধু ভর্তা-ভাত খাব। আর সেই টাকাটা আমরা জমিয়ে রাখব।"
 
মা অবাক হয়ে বললেন, "কেন? আমাদের কি অভাব পড়েছে?"
 
"অভাব আমাদের পড়েনি মা, অভাব পড়েছে আমাদের ঈমানে। আমরা বড্ড বেশি আরামপ্রিয় হয়ে গেছি। রাসুল (সা.) দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতেন। আর আমরা তিন বেলা রাজকীয় খাবার খেয়েও বলি—'আল্লাহ কী দিলেন?' মা, আমি চাই না কিয়ামতের দিন আল্লাহ আমাদের নিয়ামতের হিসাব নিতে গিয়ে আটকে দিন।"
 
মায়ের চোখটা ছলছল করে উঠল। মায়েরা সন্তানের কথা বোঝেন। মা কাছে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। "তুই অনেক বদলে গেছিস রে। তোর বাবার মতো হয়েছিস। তোর বাবাও বলতেন, 'সাদা ভাত আর ডাল, সাথে আল্লাহর শুকরিয়া—এর চেয়ে বড় পোলাও আর হয় না।'"
 
আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। এই প্রথম মনে হলো, আমার যুদ্ধের একজন সেনাপতি আমি পেয়ে গেছি। আমার মা। ঘর থেকেই বিপ্লব শুরু করতে হয়।
 
ঘরে এসে ওজু করে নিলাম। তাহাজ্জুদের সময় হয়নি, কিন্তু নফল নামাজ পড়া যায়। জায়নামাজে দাঁড়ালাম। সূরা ইখলাস পড়লাম। "কুল হুয়াল্লাহু আহাদ"। আল্লাহ এক। অদ্বিতীয়। তার কোনো শরিক নেই।
 
নামাজ শেষে মোনাজাতে হাত তুললাম। হঠাৎ মনে হলো, আমি কার জন্য দোয়া করব? নিজের জন্য? না। আজ দোয়া করব আমার সেই চাচার জন্য, যিনি আমাকে 'পাগল' বললেন। দোয়া করব সেই মানুষগুলোর জন্য, যারা খাবার নষ্ট করল। কারণ তারা জানে না তারা কী করছে। তারা গাফলতে (উদাসীনতায়) আছে।
 
"হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জাতিকে ক্ষমা করো। আমাদের অন্তর থেকে দুনিয়ার মোহ দূর করে দাও। আমাদের চোখ খুলে দাও। গাজার মাটির নিচে যারা শুয়ে আছে, তাদের উসিলায় আমাদের মৃত অন্তরগুলো জিন্দা করে দাও।"
 
কান্না পাচ্ছে না। কান্না শুকিয়ে গেছে। কিন্তু বুকের ভেতর একটা আগুন অনুভব করছি। এই আগুনটা নেভানো যাবে না। এই আগুনটাই আমাকে এগিয়ে নেবে।
 
বিছানায় শুতে গেলাম। নরম তোশক। কিন্তু পিঠে কাঁটার মতো বিঁধছে। গাজার মানুষরা এখন পাথরের ওপর ঘুমাচ্ছে। আমি বালিশটা সরিয়ে রাখলাম। ফ্লোরে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়লাম। মা দেখলে বকবেন। কিন্তু আজ রাতে আমি একটু কষ্ট করতে চাই। একটু অনুভব করতে চাই—পাথর বিছানা কেমন হয়।
 
চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। মস্তিষ্কে হাজারো চিন্তা। প্রজেক্ট 'রুহানিয়া'র পরবর্তী ধাপ কী হবে? মানুষকে শুধু ফেসবুকে লিখে জাগানো যাবে না। মাঠে নামতে হবে। মসজিদগুলোতে যেতে হবে। ইমাম সাহেবদের সাথে কথা বলতে হবে। জুমার খুতবায় যেন ফিলিস্তিন আর আমাদের আত্মশুদ্ধি নিয়ে আরও জোরালো কথা বলা হয়, সে চেষ্টা করতে হবে।
 
হঠাৎ তানভীরের ফোন। এত রাতে?
 
"হ্যালো?"
 
"দোস্ত, ঘুমাসনি?" তানভীরের গলা উত্তেজিত।
 
"না, বল।"
 
"সাকিব আর আমি একটা প্ল্যান করেছি। আমাদের অফিসের কলিগদের নিয়ে একটা 'স্টাডি সার্কেল' করব। সপ্তাহে একদিন। লাঞ্চ আওয়ারে। আমরা কোনো হুজুর ডাকব না, আমরা নিজেরাই কুরআন পড়ব, হাদিস পড়ব, আর সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তুই থাকবি?"
 
বুকটা গর্বে ভরে গেল। "অবশ্যই থাকব। এটাই তো চাই তানভীর! জ্ঞান অর্জন ছাড়া এই উম্মাহ জাগবে না। আবেগ দিয়ে দুদিন চলা যায়, কিন্তু জ্ঞান দিয়ে শতাব্দী পার করা যায়।"
 
"আরেকটা কথা," তানভীর একটু থামল। "আমার ওয়াইফ... ও আজ আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, 'তুমি ইদানীং এত চুপচাপ কেন?' আমি ওকে সব খুলে বললাম। ও প্রথমে রাগ করেছিল। কিন্তু পরে যখন গাজার সেই বাচ্চার ছবিটা দেখালাম... ও অনেকক্ষণ কাঁদল। ও বলেছে, আগামী মাসে ও ওর জমানো টাকা দিয়ে এতিমখানায় কিছু শীতের কাপড় দেবে।"
 
"আল্লাহু আকবার!" আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল।
 
"দোস্ত, বরফ গলছে," তানভীর বলল।
 
"হ্যাঁ, বরফ গলছে। ইনশাআল্লাহ একদিন প্লাবন আসবে।"
 
ফোন রাখার পর আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এই হাসিটা বিজয়ের হাসি নয়, এই হাসিটা আশার হাসি। শয়তান আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু সে ভুলে গেছে—মুমিনের ঘুমও ইবাদত, আর জাগরণ হলো বিপ্লব।
 
বাইরে কুয়াশা বাড়ছে। জানালার কাচে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। আমি আঙুল দিয়ে কাচের ওপর লিখলাম—"ফিলিস্তিন"। তারপর মুছে ফেললাম। না, শুধু কাঁচে লিখলে হবে না, হৃদয়ে লিখতে হবে।
 
কাল সকালে নতুন সূর্য উঠবে। সেই সূর্যের আলোয় আমি আমার পুরনো জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে বের হবো। লোকে হয়তো বলবে 'আনস্মার্ট'। কিন্তু আমি জানব, আমার এই পুরনো জ্যাকেটের পকেটে আছে এক আকাশ সমান আত্মতৃপ্তি।
 
কারণ আমি এখন আর দুনিয়ার ব্র্যান্ড খুঁজি না, আমি খুঁজি আল্লাহর সন্তুষ্টির ব্র্যান্ড। আর সেই ব্র্যান্ডের ট্যাগলাইন হলো—"ইন্নাল্লাহা মা'আস সাবেরিন" (নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন)।
 
আমার যাত্রা শুরু হলো। একা নয়, আমরা এখন দলবদ্ধ। গন্তব্য অনেক দূর। কিন্তু পথ চলাই তো জীবন।
 
"ওরা বলে স্বপ্ন দেখা পাপ,
আমি বলি, স্বপ্নই তো জীবনের মাপ।
ওরা গড়ে ইটের পাঁজর, পাথরের ঘর,
আমি গড়বো রুহের মিনার, নেই কোনো ডর।
জেগে ওঠো হে যুবক, সময় যে যায়,
রক্তের দামে কেনা দ্বীন, লুটাবে কি ধুলোয়?"
 
[রুহানিয়া]
[৪]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Send as a message
Share on my page
Share in the group
Translation is not possible.
সন্ধ্যা নামার ঠিক আগমুহূর্তে আকাশের রংটা কেমন যেন বিষণ্ন হয়ে যায়। ধূসর আর কমলার এক অদ্ভুত মিশেল। আমার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসা সেই সুরের রেশ এখনো কানে বাজছে। আজকের সন্ধ্যাটা অন্য দিনের মতো নয়। আজ আমি এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি। কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বা তরবারি নিয়ে নয়, আজ যুদ্ধ হবে যুক্তি, বুদ্ধি আর রুহানিয়াতের। আমার বন্ধু তানভীর আসবে। ওকে আমি দাওয়াত দিয়েছি। শুধু চায়ের দাওয়াত নয়, এটা আসলে ওর ঘুমন্ত বিবেককে জাগানোর এক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
 
তানভীর আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ও খারাপ মানুষ নয়। বরং দুনিয়াবি মানদণ্ডে ও একজন সফল এবং 'ভদ্র' মানুষ। ভালো চাকরি, সুন্দর পরিবার, সামাজিক স্ট্যাটাস—সবই আছে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, ও সেই 'মডারেট' ধোঁকাবাজির শিকার, যা আমাদের প্রজন্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। ও মনে করে ইসলাম হলো একটা কালচারাল অনুষ্ঠান। ঈদ এলে পাঞ্জাবি পরা আর জুমার দিনে আতর মাখাই ইসলামের সর্বোচ্চ সীমা। এর বাইরে ইসলামকে ও 'ব্যাকডেটেড' মনে করে। আর ফিলিস্তিন? ওর কাছে ওটা শুধুই একটা আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম।
 
দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। আমি গিয়ে দরজা খুললাম। তানভীর দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা দামী মিষ্টির প্যাকেট। মুখে সেই চিরচেনা করপোরেট হাসি।
"কী রে, তুই তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি মেসেজটা দিয়ে! বললি কাবাব খাবি না, আবার বলছিস গরম কিছু শোনাবি। আমি তো ভাবলাম তুই সন্ন্যাসী হয়ে গেলি নাকি!" তানভীর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ঠাট্টা করল।
 
আমি হাসলাম। ম্লান হাসি। "সন্ন্যাসী হবো কেন? আমি তো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি। সেটাই বা কম কিসে?"
 
তানভীর সোফায় বসল। ঘরটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। আমার ড্রয়িংরুমের সেই বিশাল এলইডি টিভিটা আজ কাপড়ে ঢাকা। বুকশেলফ থেকে ধুলো ঝেড়ে ইসলামি বইগুলো সামনে এনে রেখেছি। তানভীরের ভুরু কুঁচকে গেল।
 
"টিভি ঢাকা কেন? নষ্ট নাকি?"
 
"না, নষ্ট না। তবে ওটা চালু থাকলে আমরা নিজেদের কথা শুনতে পাই না। অন্যের শেখানো বুলি শুনতে থাকি। আজ আমরা নিজেদের কথা শুনব।"
 
আমি চা বানিয়ে এনেছিলাম। সাথে কিছু বিস্কুট। মিষ্টির প্যাকেটটা খুললাম না। তানভীর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, "তুই সিরিয়াসলি কিছু একটা নিয়ে ডিস্টার্বড। ওই জ্যাকেটের ব্যাপারটা এখনো মাথায় ঘুরছে? দেখ দোস্ত, চ্যারিটি করা ভালো। কিন্তু তাই বলে নিজের লাইফস্টাইল ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হতে হবে, এটা ইসলাম বলে না।"
 
আমি তানভীরের চোখের দিকে তাকালাম। "তানভীর, ইসলাম সন্ন্যাসবাদ সমর্থন করে না, এটা সত্য। কিন্তু ইসলাম কি ভোগবাদ সমর্থন করে? এই যে তুই বলছিস লাইফস্টাইল, এই লাইফস্টাইলটা কে ঠিক করে দিয়েছে? পশ্চিমারা? ওরা আমাদের শিখিয়েছে—'খরচ করো, তাহলেই তুমি সুখী।' কিন্তু তুই কি সত্যি সুখী? তোর কি রাতে ঘুমের ওষুধ খেতে হয় না? তোর কি মাসের শেষে ইএমআই এর টেনশন থাকে না? তোর কি মনে হয় না, তুই একটা ইঁদুর দৌড়ের মধ্যে আছিস, যার কোনো শেষ নেই?"
 
তানভীর একটু থমকে গেল। হয়তো আমার কথাগুলো ওর কোনো গোপন ক্ষততে আঘাত করেছে। ও বলল, "সেটা তো মডার্ন লাইফের পার্ট। স্ট্রেস থাকবেই। তাই বলে কি সব ছেড়ে গুহায় চলে যাব?"
 
"গুহায় যেতে বলিনি। আমি বলছি, আমাদের প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকারের কথা। আজ গাজায় আমাদের ভাই-বোনেরা যখন এক টুকরো রুটির জন্য জীবন দিচ্ছে, তখন আমরা এখানে বসে কোন ব্র্যান্ডের পিজ্জা অর্ডার করব—সেটা নিয়ে ডিবেট করছি। এটা কি অসুস্থতা নয়? তুই বলছিলি ফিলিস্তিন নিয়ে আমরা কিছু করতে পারব না। কেন পারব না? আমাদের কি হাত-পা বাঁধা?"
 
তানভীর চায়ের কাপটা টেবিলে রাখল। ওর ভঙ্গি এখন কিছুটা ডিফেন্সিভ। "কী করবি তুই? ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিবি? প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করবি? নাকি কোকাকোলা খাওয়া বাদ দিবি? তাতে ইসরায়েলের কী এসে যায়? ওদের ইকোনমি বিলিয়ন ডলারের। তোর এই দশ টাকার বর্জন ওদের লোমও ছিড়তে পারবে না। এগুলো ইমোশনাল বোকামি।"
 
এটাই সেই যুক্তি, যা শয়তান আমাদের মগজে খুব শক্তভাবে গেঁথে দিয়েছে। আমি শান্ত গলায় বললাম, "তানভীর, আবরাহার হস্তী বাহিনীর কথা মনে আছে? তারা যখন কাবা শরীফ ধ্বংস করতে এসেছিল, তখন তাদের মোকাবিলা করেছিল কারা? কোনো বিশাল সেনাবাহিনী? না। আবাবিল পাখি। ছোট্ট সব পাখি, ঠোঁটে ছোট্ট পাথর। ওই পাথরের কি ক্ষমতা ছিল হাতির পিঠের চামড়া ভেদ করার? ফিজিক্সের লজিক অনুযায়ী ছিল না। কিন্তু ওই পাথরের সাথে ছিল আল্লাহর হুকুম। আমরা যখন কোকাকোলা বা কেএফসি বর্জন করি, তখন আমরা আসলে ইসরায়েলের ইকোনমি ধসিয়ে দেওয়ার জন্য করি না। আমরা করি আমাদের 'ইজ্জত' বা আত্মসম্মান বাঁচানোর জন্য। আমরা আল্লাহকে দেখাই—'হে আল্লাহ! আমার সামর্থ্য এটুকুই ছিল। আমি জালিমের বুলেটের টাকা জোগান দিইনি।' এটা একটা অবস্থান। এটা একটা স্টেটমেন্ট।"
 
তানভীর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, "অবস্থান দিয়ে যুদ্ধ জয় হয় না। পাওয়ার লাগে। টেকনোলজি লাগে।"
 
"পাওয়ার তো আমাদের ছিল তানভীর। অটোমানদের পাওয়ার ছিল, আব্বাসীয়দের ছিল। কিন্তু যখন তারা ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দিল, তখন সেই পাওয়ার চলে গেল। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, 'তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো, তবে তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সুদৃঢ় করবেন।' আমরা আল্লাহকে সাহায্য করা বন্ধ করে দিয়েছি, তাই আল্লাহও আমাদের সাহায্য তুলে নিয়েছেন। আমরা টেকনোলজির দোহাই দিচ্ছি, কিন্তু বদরের যুদ্ধে সাহাবীদের কি টেকনোলজি ছিল? ৩১৩ জন মানুষ, হাতে গোনা কয়েকটা তলোয়ার। আর বিপক্ষে হাজার খানেক সুসজ্জিত সৈন্য। লজিক কী বলে? সাহাবীদের কচুকাটা হওয়ার কথা। কিন্তু রেজাল্ট কী হলো? ফেরেশতারা নেমে এল। কেন? কারণ তাদের ঈমান ছিল নিখাদ। আর আমাদের ঈমানে ভেজাল। আমরা সকালে আল্লাহকে ডাকি, বিকেলে সুদের কারবার করি। আমাদের দুআ কি কবুল হবে?"
 
তানভীর চুপ করে আছে। আমি উঠে গিয়ে বুকশেলফ থেকে একটা বই আনলাম। ইবনে কাসিরের ইতিহাস। একটা পাতা খুলে ধরলাম।
 
"শোন, তাতাররা যখন বাগদাদ আক্রমণ করল, তখন বাগদাদের খলিফা ছিলেন মুসতাসিম বিল্লাহ। তার প্রাসাদে সোনা-দানার অভাব ছিল না। কিন্তু তিনি সৈন্যদের বেতন ঠিকমতো দিতেন না। বিলাসিতায় মগ্ন ছিলেন। তাতার নেতা হালাকু খান যখন তাকে বন্দি করল, তখন তাকে একটা শূন্য ঘরে আটকে রাখা হলো। সেই ঘরে শুধু সোনা আর হীরা-জহরত ছিল, কিন্তু কোনো খাবার বা পানি ছিল না। হালাকু খান বলল, 'তুমি তো অনেক সোনা জমিয়েছ। এখন এগুলো খাও।' খলিফা ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করতে করতে ওই সোনার স্তূপের ওপর মরে পড়ে রইলেন। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় তানভীর। আমরা এখন সেই বাগদাদের নাগরিকদের মতো। আমরা ভাবছি আমাদের টাকা, আমাদের আমেরিকা-প্রীতি আমাদের বাঁচাবে। কিন্তু যেদিন আল্লাহর গজব আসবে, সেদিন এই ক্রেডিট কার্ড আর পাসপোর্ট কোনো কাজে আসবে না।"
 
তানভীরের মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও হয়তো কল্পনা করার চেষ্টা করছে দৃশ্যটা। আমি আবার বললাম, "তুই গাজার নিউজ দেখিস না, আমি জানি। তোর খারাপ লাগে। কিন্তু ওই খারাপ লাগাটা জরুরি। ওটা তোর মৃতপ্রায় রুহটাকে ধাক্কা দেয়। গতকাল একটা ভিডিও দেখলাম। এক বাবা তার দুই সন্তানের লাশ দুই হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। বাচ্চাগুলোর শরীর ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু বাবাটা কাঁদছে না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে বলছে, 'আলহামদুলিল্লাহ! আমার বাচ্চারা জান্নাতের পাখি হয়ে গেছে। আল্লাহ তুমি কবুল করো।' তুই কল্পনা করতে পারিস তানভীর? কী লেভেলের ঈমান হলে মানুষ লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারে? আর তুই? গত সপ্তাহে তোর গাড়িতে একটা স্ক্র্যাচ পড়ল বলে তুই সারাদিন মেজাজ খারাপ করে রাখলি। ড্রাইভারকে গালি দিলি। তোর আর ওই গাজার বাবার মধ্যে তফাৎটা দেখ। সে সব হারিয়েও ধনী, আর তুই সব থেকেও ভিখারি।"
 
তানভীর মাথা নিচু করল। ওর হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। ও হয়তো স্বীকার করতে চাইছে না, কিন্তু সত্যটা তীরের মতো বিঁধছে। কিছুক্ষণ পর ও ফিসফিস করে বলল, "কিন্তু আমি কী করব? আমি তো সাধারণ মানুষ। আমি তো আর জিহাদে যেতে পারব না।"
 
আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম। "জিহাদ মানে শুধু তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করা নয়। জিহাদ মানে সংগ্রাম। নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। শয়তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তুই যদি আজ সিদ্ধান্ত নিস যে, তুই আর হারাম পথে টাকা কামাবি না—সেটা জিহাদ। তুই যদি সিদ্ধান্ত নিস যে, তুই ফিলিস্তিনের পণ্য বয়কট করবি—সেটা জিহাদ। তুই যদি ফজরের সময় আরামের ঘুম হারাম করে মসজিদে যাস—সেটা জিহাদ। আল্লাহ তোকে গাজা স্বাধীন করতে বলেননি, আল্লাহ তোকে জিজ্ঞেস করবেন—'তুমি তোমার সাধ্যমতো কী করেছ?'"
 
তানভীর মুখ তুলল। ওর চোখে এখন আর সেই তাচ্ছিল্য নেই। আছে এক ধরনের অসহায়ত্ব। "জানিস দোস্ত, মাঝে মাঝে আমার খুব ভয় লাগে। মনে হয় আমি একটা মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। অফিসে এত পলিটিক্স, এত মিথ্যা কথা বলতে হয় ক্লায়েন্টদের সাথে... রাতে যখন বাড়ি ফিরি, নিজেকে খুব নোংরা মনে হয়। মনে হয়, এই জীবনটার কোনো মানে নেই। শুধু খাওয়া, পরা আর ঘুমানো। পশুর সাথে আমাদের তফাৎটা কী?"
 
"তফাৎটা হলো 'রুহ' বা আত্মা। পশুর আত্মা নেই, আমাদের আছে। কিন্তু আমরা সেই আত্মাকে ক্ষুধার্ত রেখেছি। আমরা শরীরকে ফিড করছি বার্গার-পিজ্জা দিয়ে, কিন্তু আত্মাকে কুরআন বা জিকির দিয়ে ফিড করছি না। তাই আত্মাটা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। আর আত্মা যখন মরে যায়, তখন মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগে। সুইসাইড করতে চায়। কারণ তার অস্তিত্বের কোনো পারপাস থাকে না। তানভীর, ফিরে আয়। এখনো সময় আছে।"
 
"কীভাবে ফিরব? এত পাপ করেছি... আল্লাহ কি মাফ করবেন?"
 
আমি মুচকি হাসলাম। "শোন, কুরআনের একটা আয়াত বলি। আল্লাহ বলছেন, 'বলো, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেন।' আল্লাহ তো অপেক্ষায় আছেন। তিনি চান তুই ফিরে আয়। তুই এক পা বাড়ালে তিনি দশ পা এগিয়ে আসবেন। তুই হেঁটে গেলে তিনি দৌড়ে আসবেন। তোর মালিক তো এত দয়ালু!"
 
তানভীরের চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এই এক ফোঁটা পানি হয়তো সাগরের চেয়েও ভারী। কারণ এটা অনুশোচনার অশ্রু। জাহান্নামের আগুন নেভানোর জন্য এই এক ফোঁটা পানিই যথেষ্ট হতে পারে।
 
আমি উঠে দাঁড়ালাম। বারান্দার দরজাটা খুলে দিলাম। ঠান্ডা বাতাস হু হু করে ঘরে ঢুকল।
 
"তানভীর, চল বারান্দায় দাঁড়াই।"
 
আমরা দুজনে বারান্দায় দাঁড়ালাম। নিচে শহরের আলো জ্বলছে। কোটি কোটি মানুষ। সবার নিজস্ব গল্প, নিজস্ব ব্যস্ততা।
 
"ওই দেখ," আমি আকাশের দিকে আঙুল তুললাম। "ওই আকাশের মালিক আর গাজার আকাশের মালিক একজনই। আমরা এখানে আরামে দাঁড়িয়ে আছি, আর ওখানে বোমাবর্ষণ হচ্ছে। কিন্তু জানিস, কিয়ামতের দিন হয়তো ওই গাজাবাসীরাই আমাদের দেখে আফসোস করবে না, বরং আমরা তাদের দেখে আফসোস করব। তারা বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যাবে, আর আমাদের পাই-পাই করে হিসাব দিতে হবে—কেন আমরা নীরব ছিলাম? কেন আমরা আমাদের টাকার গরম দেখিয়েছি?"
 
তানভীর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, "তুই যে প্রজেক্টের কথা বলেছিলি... ওই যে নিজেকে বদলানোর... ওটা আমাকে দিবি? আমি ট্রাই করতে চাই। আমি জানি না পারব কি না, কিন্তু আমি আর এভাবে বাঁচতে চাই না। আমি শ্বাস নিতে পারছি না এই প্লাস্টিকের দুনিয়ায়।"
 
আমার বুকটা ভরে গেল। আলহামদুলিল্লাহ। বরফ গলতে শুরু করেছে। আমি পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বের করে ওর হাতে দিলাম। সেই চারটি পয়েন্টের তালিকা।
 
তানভীর কাগজটা হাতে নিয়ে মোবাইলের আলোয় পড়ল।
১. নিজেকে পরিবর্তন করা (পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কুরআন পাঠ)।
২. অপচয় এবং বিলাসিতা বর্জন (অপ্রয়োজনীয় শপিং বন্ধ)।
৩. জ্ঞান অর্জন (ইসলাম ও জিওপলিটিক্স)।
৪. মানুষকে সচেতন করা (দাওয়াহ)।
 
"দ্বিতীয় পয়েন্টটা কঠিন," তানভীর বলল। "আমার স্ত্রী... ও তো এসব মানবে না। ও তো প্রতি সপ্তাহে শপিংয়ে যেতে চায়।"
 
"শুরুটা তোকে করতে হবে। তুই যখন পরিবর্তন হবি, তখন তোর পরিবারের ওপর তার প্রভাব পড়বে। প্রথমে ঝড় আসবে, অশান্তি হবে। কিন্তু তুই যদি অটল থাকিস, আল্লাহ সাহায্য করবেন। হযরত আসিয়া (আ.) ফেরাউনের ঘরে থেকেও মুমিন ছিলেন। আর তুই তো তোর নিজের ঘরে। বুঝিয়ে বল। ভালোবাসা দিয়ে বল। আর সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহর কাছে দুআ কর। অন্তরের পরিবর্তন তো আল্লাহর হাতে।"
 
তানভীর কাগজটা পকেটে ঢোকাল। "আজ আমি উঠব। রাত হয়েছে।"
 
"দাঁড়া, একটা জিনিস নিয়ে যা।"
 
আমি ভেতরের ঘর থেকে সেই নতুন কেনা নয়, বরং আমার খুব প্রিয় একটা আতরের শিশি নিয়ে এলাম। "এটা রাখ। সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাহ। যখনই এটা মাখবি, মনে করবি এটা দুনিয়ার সুগন্ধি, জান্নাতের সুগন্ধি এর চেয়ে কোটি গুণ বেশি। আর সেই সুগন্ধি পেতে হলে একটু কষ্ট করতে হবে দোস্ত।"
 
তানভীর আতরটা নিল। যাওয়ার সময় ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর আলিঙ্গনে আগের সেই আলগা ভাবটা নেই। এবার একটা শক্ত বাঁধন অনুভব করলাম। যেন ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরেছে।
 
"দোয়া করিস আমার জন্য," তানভীর বলল। গলাটা ধরা।
 
"অবশ্যই। আমরা একে অপরের আয়না। তোর ময়লা পরিষ্কার হলে আমার চেহারাই সুন্দর দেখাবে।"
 
তানভীর চলে গেল। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনলাম। সিঁড়িতে তার পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। কিন্তু রেখে গেল এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
 
আমি আবার ঘরে ফিরে এলাম। চায়ের কাপগুলো পড়ে আছে। বিস্কুটগুলো খাওয়া হয়নি। কিন্তু আজ আমার পেট ভরা না থাকলেও মনটা ভরা। শয়তান আজ হেরে গেছে। অন্তত একটা রাউন্ডে।
 
রাত গভীর হচ্ছে। আমি ল্যাপটপটা আবার খুললাম। 'Project Awakening' ফোল্ডারে নতুন একটা ফাইল খুললাম। নাম দিলাম—"The Ripple Effect" (ঢেউয়ের প্রভাব)।
 
পুকুরে একটা ঢিল ছুড়লে যেমন ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি একজন মানুষের জাগরণ হাজার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তানভীর যদি বদলায়, ওর অফিসের কলিগরা দেখবে। ওর পরিবার দেখবে। হয়তো কেউ হাসবে, কেউ টিটকারি মারবে। কিন্তু কেউ কেউ ভাববে। ওই ভাবনাটাই আসল।
 
ইসলাম কোনো ম্যাজিক পিল নয় যে খেলাম আর সব ঠিক হয়ে গেল। ইসলাম হলো এক নিরন্তর সংগ্রাম। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা। সবাই যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে না গিয়ে সত্যের দিকে যাওয়া।
 
মনে মনে একটা কবিতা আওড়াতে লাগলাম—
"ঘুমিয়ে ছিলে মখমলে, ভুলে ছিলে পথ,
জাগল কি আজ বিবেকের রুদ্ধ মনোরথ?
ওরা মরে লাখে লাখে, তুমি আছো সুখে,
লজ্জা কি হয় না বলো, তাকাতে ওই মুখে?
এক হয়ে যাও উম্মাহ, ভাঙো ভয়ের বাঁধ,
আঁধার চিরে উঠবেই দেখো নতুন এক চাঁদ।"
 
হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। তানভীরের মেসেজ।
 
"দোস্ত, গাড়িতে উঠে রেডিও অন করেছিলাম। গান বাজছিল। অফ করে দিলাম। এখন চুপচাপ ড্রাইভ করছি। এই নীরবতাটা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আল্লাহ আমার সাথে আছেন। জ্যাকেটের ব্যাপারটা... আমি কালই দেখব আমার আলমারিতে কয়টা এক্সট্রা কাপড় আছে। ভালো থাকিস।"
 
আমি মোবাইলটা বুকে চেপে ধরলাম। সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহ, তুমি কত মহান! তুমি যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দাও। আমরা শুধুই ওসিলা।
 
কিন্তু যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এটা মাত্র শুরু। গাজার রক্ত এখনো ঝরছে। সুদানের, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাংলাদেশ—কোথায় নেই হাহাকার? আমাদের ব্যক্তিগত পরিবর্তনকে এবার সমষ্টিগত শক্তিতে রূপ দিতে হবে। আমাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কেন আমরা পিছিয়ে পড়লাম? কেন আমাদের সম্পদ থাকার পরও আমরা ভিখারি? কেন আমাদের সংখ্যা বেশি হওয়ার পরও আমরা ফেনার মতো ভেসে যাই?
 
রাসুল (সা.) বলেছিলেন, "এমন এক সময় আসবে যখন অন্যান্য জাতি তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, যেমন ক্ষুধার্তরা খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।" সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, "আমরা কি তখন সংখ্যায় কম হব?" রাসুল (সা.) বললেন, "না, তোমরা তখন সংখ্যায় অনেক হবে। কিন্তু তোমরা হবে বন্যার ফেনার মতো। আর তোমাদের অন্তর থেকে শত্রুর ভয় দূর হয়ে যাবে এবং তোমাদের অন্তরে 'ওয়াহন' ঢুকে যাবে।" সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, "'ওয়াহন' কী?" তিনি বললেন, "দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা আর মৃত্যুর প্রতি ভয়।"
 
আজকের এই সন্ধ্যা আমাকে বুঝিয়ে দিল, এই 'ওয়াহন' বা দুর্বলতা কাটানোর একমাত্র ওষুধ হলো ঈমানের নবায়ন। আমাদের মৃত্যুকে ভয় পাওয়া বন্ধ করতে হবে। মৃত্যু তো আসবই। কিন্তু ভীরুর মতো মরা আর বীরের মতো মরার মধ্যে তফাৎ আছে। বিছানায় শুয়ে মরার চেয়ে সত্যের পথে দাঁড়িয়ে মরা অনেক সম্মানের।
 
আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দূরের মসজিদ থেকে এশার আজান ভেসে আসছে। "হাইয়্যা আলাল ফালাহ"—এসো কল্যাণের দিকে। পৃথিবীর সব কল্যাণ এখন ওই সিজদার মধ্যে। আমি আর দেরি করলাম না। ওজু করতে গেলাম। পানিটা এখনো ঠান্ডা। কিন্তু এখন আর সেটা কষ্ট মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এই পানি আমাকে প্রস্তুত করছে। এক নতুন যুদ্ধের জন্য। এক নতুন ভোরের জন্য।
 
যে ভোরের অপেক্ষায় আছে ফিলিস্তিন। যে ভোরের অপেক্ষায় আছে নির্যাতিত মানবতা। আর সেই ভোর আসবে আমাদের হাত ধরেই ইনশাআল্লাহ। আমরাই সেই আনসার, আমরাই সেই মুহাজির। শুধু সময়ের ব্যবধান।
 
[রুহানিয়া]
[৩]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Send as a message
Share on my page
Share in the group