জীর্ণ এক চালের নিচে আমাদের বসবাস। রোদের তীব্রতা আর বৃষ্টির ছাট—উভয়ই আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। শহরের নোনা ধরা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের কাতারে হয়তো আমাদের নাম সবার আগে। লোকে আমাদের বলে নিম্নবিত্ত, কেউবা করুণার চোখে তাকায়, আবার কেউবা অবজ্ঞার।
কিন্তু এই জীর্ণ পোশাক আর অভাবের সংসারের ভেতরেও এমন এক অদৃশ্য সম্পদ আমাদের আছে, যা বড় বড় অট্টালিকার বাসিন্দাদের সিন্দুক হাতড়ালেও মিলবে না। সেই সম্পদ হলো ‘গাইরত’ বা আত্মমর্যাদাবোধ এবং হালাল-হারামের সুতীব্র চেতনা।
আমাদের পকেট হয়তো অধিকাংশ সময় শূন্য থাকে, মাস ফুরোলে দীর্ঘশ্বাসের শব্দে বাতাস ভারী হয়, কিন্তু আমাদের হৃদয়ের প্রশান্তিটুকু এক মহাসমুদ্রের মতো গভীর।
আমরা জানি, অভাবের তাড়নায় পেট পুড়লেও, হারামের এক লোকমা খাবার দিয়ে সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করা মানে পরকালের অনন্ত আগুনকে নিজের পেটে ধারণ করা। এই বোধটুকু আমাদের ধমনীতে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়।
পৃথিবীটা এখন বড় অদ্ভুত। এখানে যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত হয় ব্যাংকের অংক আর গাড়ির মডেলে। কিন্তু আমরা যারা মাটির কাছাকাছি থাকি, আমরা জীবনকে দেখি ভিন্ন এক প্রিজমে। আমাদের কাছে জীবনের সার্থকতা ভোগে নয়, বরং ত্যাগে এবং পবিত্রতায়।
বলতে হয়— আধুনিকতা আমাদের শিখিয়েছে ‘মোর ইজ বেটার’, কিন্তু আমাদের ঈমান শেখায় ‘পিওর ইজ বেটার’। অল্প হোক, কিন্তু তা যেন স্বচ্ছ ঝর্ণার মতো পবিত্র হয়।
সকালবেলা যখন একজন নিম্নবিত্ত বাবা কাজের সন্ধানে বের হন, তার পায়ে হয়তো তালি দেওয়া জুতো, কিন্তু তার কপালে সেজদার দাগ। তিনি জানেন, দিনশেষে তাকে খালি হাতে ফিরতে হতে পারে, কিন্তু তিনি এও জানেন যে, অসদুপায়ে অর্জিত বিরিয়ানির চেয়ে ঘাম ঝরানো উপার্জনের নুন-ভাত অনেক বেশি তৃপ্তিদায়ক।
এই তৃপ্তিটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, এটা আসে ওপরওয়ালার পক্ষ থেকে। এটা হলো সেই প্রশান্তি, যা আল্লাহ কেবল তাঁর প্রিয় বান্দাদের কালবে নাজিল করেন।
মুমিনের জন্য দুনিয়াটা তো জেলখানা। জেলখানায় কেউ আয়েশ করতে আসে না, এখানে নিয়ম মানতে হয়। আমাদের এই অভাব, এই টানাটানি—এগুলো তো সেই পরীক্ষারই অংশ। আমরা যখন দেখি, চারপাশের মানুষ সুদের কারবার করে চোখের পলকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে, ঘুষের টাকায় আকাশচুম্বী বাড়ি বানাচ্ছে, তখন আমাদের নফস যে ধোঁকা খায় না, তা নয়। শয়তান এসে ফিসফিস করে বলে,
“একবারই তো! সবাই তো করছে, তুমি করলে দোষ কী?”
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের গাইরত জেগে ওঠে। মনে পড়ে যায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেই হাদিসটি, যেখানে তিনি বলেছেন,
“যে শরীর হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”
এই একটি বাক্য আমাদের শিরদাঁড়া সোজা করে দেয়। আমরা ভাবি, যে শরীরের জন্য এত আয়োজন, তা তো কদিন পর মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু রুহ? তার কী হবে? ক্ষণিকের সুখের জন্য অনন্তকালের বিনাশ আমরা সইতে পারব না।
আমাদের ঘরের চিত্রগুলো বড় মায়াময়, আবার বড় করুণ। ঈদের সময় হয়তো সন্তানের আবদার মেটানো সম্ভব হয় না। পাশের বাসার ছেলেটি যখন নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়ায়, আমাদের সন্তান তখন পুরনো জামাটাকেই ধুয়ে ইস্ত্রি করে পরে। এই দৃশ্য বাবার বুকে শেল বিঁধিয়ে দেয়, মায়ের চোখের কোণে পানি জমায়। কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানদের শেখাই—
“বাবা, আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু আমরা ভিখারি নই। আমরা আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে হাত পাতি না।”
এই যে ছোটবেলা থেকেই হালাল-হারামের বীজটা তাদের মনে বুনে দেওয়া, এটাই আমাদের আসল উত্তরাধিকার।
আমাদের সন্তানরা হয়তো দামী খেলনা পায় না, কিন্তু তারা পায় সততার শিক্ষা। তারা দেখে, বাবা ক্ষুধার্ত থেকেও অন্যের হক মারে না। মা ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করে পরে, তবুও বাবার ওপর অন্যায্য আয়ের চাপ দেয় না। এই যে নীরব তারবিয়াত, এটা কোনো স্কুল-কলেজে শেখানো হয় না। এটা আমাদের কুঁড়েঘরের মাদ্রাসা থেকে অর্জিত।
বাস্তবতা বড় কঠিন। বাজারে গেলে যখন দ্রব্যমূল্যের আগুনে হাত পুড়ে যায়, তখন অসহায় লাগে। পকেটের পয়সা গুনে যখন চালের বদলে খুদ কিনতে হয়, তখন দীর্ঘশ্বাস বের হয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে খন্দকের যুদ্ধের কথা।
মনে পড়ে, জগতবাসীর শ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সা.)-এর পেটে পাথর বাঁধার দৃশ্য। তিনি কি পারতেন না উহুদ পাহাড়কে সোনা বানিয়ে দিতে? আল্লাহ তো তাকে সেই প্রস্তাবই দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন অভাব আর সবরের জীবন।
আমরা সেই নবীর উম্মত। আমাদের অভাব দেখে যারা উপহাস করে, তারা জানে না যে, আমরা আসলে নববীয়তের এক কঠিন সুন্নতের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
অভাব আমাদের লজ্জিত করে না, বরং আমাদের অহংকারী হওয়া থেকে বাঁচায়। ধন-সম্পদ মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে, আর অভাব মানুষকে রবের দরজায় নত রাখে। আমরা এই নত থাকাটাকেই আমাদের শক্তি মনে করি।
সমাজের তথাকথিত ‘স্ট্যাটাস’ মেইনটেইন করতে গিয়ে কত মানুষ যে নিজের আত্মসম্মান, ইজ্জত বিক্রি করে দিচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। তারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে, সুদের কিস্তি শোধ করতে গিয়ে রাতের ঘুম হারাম করছে। অথচ আমরা?
আমাদের হয়তো এসি নেই, ফ্যানটাও মাঝে মাঝে শব্দ করে, কিন্তু বালিশে মাথা রাখলে আমাদের সাথে সাথে ঘুম চলে আসে। কারণ, আমাদের ঘাড়ে কোনো জুলুমের বোঝা নেই। কারো অভিশাপ আমাদের তাড়া করে না। এই যে নির্ভার জীবন, এটা কি কোটি টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব?
কখনোই না। গাইরত বা আত্মমর্যাদা হলো এমন এক ঢাল, যা আমাদের অন্যের সামনে মাথা নত করতে দেয় না। আমরা জানি, রিযিকদাতা একমাত্র আল্লাহ। বসের তোষামোদ করে বা অন্যায়ের সাথে আপোষ করে রিযিক বাড়ে না, বরং রিযিক থেকে বরকত উঠে যায়। আমরা বরকতহীন প্রাচুর্যের চেয়ে বরকতময় অভাবকে হাজার গুণ শ্রেয় মনে করি।
হালাল উপার্জন যে কতটা কঠিন, তা কেবল ভুক্তভোগীই জানে। রিকশাচালক ভাইটি যখন প্রখর রোদে প্যাডেল ঘোরান, কিংবা গার্মেন্টস কর্মী বোনটি যখন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন—তাদের সেই ঘামের ফোঁটাগুলো আল্লাহর কাছে শহীদদের রক্তের মতোই পবিত্র হতে পারে, যদি নিয়ত ঠিক থাকে।
আমাদের সমাজের অনেকেই মনে করে, ইবাদত মানে কেবল নামাজ আর রোজা। কিন্তু হালাল রুজির সন্ধানে বের হওয়াটাও যে এক প্রকার জিহাদ, তা আমরা ভুলে যাই। আমরা নিম্নবিত্তরা এই জিহাদের ময়দানের সিপাহী। আমাদের যুদ্ধটা নফসের বিরুদ্ধে, লোভের বিরুদ্ধে।
অফিসে যখন ফাইল আটকে উপরি কামানোর সুযোগ আসে, তখন সেই সুযোগ পায়ে ঠেলে দেওয়াটা তাহাজ্জুদের চেয়ে কম ফজিলতপূর্ণ নয়। কারণ, হারাম বর্জন করা ফরয। আর এই ফরয আদায় করতে গিয়েই আমাদের সংসার চলে ধুঁকে ধুঁকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই ধুঁকে ধুঁকে চলার মাঝেও এক অলৌকিক আনন্দ আছে। সেই আনন্দ হলো বিজয়ের আনন্দ—শয়তানকে পরাজিত করার আনন্দ।
মাঝে মাঝে আমাদের স্ত্রী-কন্যারাও ধৈর্যের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করে। তারা দেখে, প্রতিবেশীর ঘরে নতুন ফার্নিচার আসছে, দামি শাড়ি আসছে। তাদেরও মন চায়। তারা তো মানুষ। কিন্তু যখনই তারা স্বামীর মলিন মুখটা দেখে, স্বামীর হালাল উপার্জনের কষ্টের কথা ভাবে, তখন তারা নিজেদের ইচ্ছেগুলোকে দাফন করে ফেলে। তারা বলে,
“আমাদের যা আছে, তাতেই চলবে।”
এই যে ‘কানাআত’ বা অল্পে তুষ্টি—এটা জান্নাতের গুপ্তধন। এই গুণটি আমাদের মা-বোনদের রানীর মর্যাদায় আসীন করেছে। তারা দুনিয়ার চাকচিক্য চায় না, তারা চায় পরকালের মুক্তি। তারা জানে, দুনিয়াটা ক্ষণস্থায়ী মুসাফিরখানা। এখানে খুব বেশি সাজগোজ করার মানে নেই। আসল বাড়ি তো ওপারে। সেখানে আল্লাহ আমাদের জন্য এমন প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হবে। সেই আশায় বুক বেঁধেই আমরা দুনিয়ার এই কষ্টের দিনগুলো পার করি।
আমরা যখন অসুস্থ হই, তখন দামী হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য আমাদের থাকে না। সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে কাতরাতে হয়। ওষুধের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে হয়তো শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করতে হয়। তবুও আমরা সুদের ওপর টাকা ধার করি না। কারণ, আল্লাহ বলেছেন,
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।”
আমরা মরে যাব, তবুও আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করব না। সুদ খাওয়া মানে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করা। আমরা দুর্বল বান্দা, আমরা কি আমাদের স্রষ্টার সাথে যুদ্ধ করে টিকতে পারব? এই ভয়টা আমাদের অন্তরে গেঁথে আছে।
তাই চিকিৎসা না পেয়ে ধুঁকে মরাটাকেও আমরা পরীক্ষার অংশ হিসেবে মেনে নিই। আমরা বিশ্বাস করি, রোগের মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনের গুনাহ মাফ করে দেন। প্রতিটি ব্যথার বিনিময়ে আমাদের আমলনামায় সওয়াব লেখা হচ্ছে। এই বিশ্বাসই আমাদের পেইনকিলার, এই বিশ্বাসই আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
আমাদের গাইরত শুধু টাকার অংকেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের নারীদের পর্দার ব্যাপারেও আমরা আপোষহীন। অভাবের তাড়নায় আমাদের মা-বোনেরা হয়তো বাইরে কাজ করে, কিন্তু তারা তাদের সম্ভ্রম বিসর্জন দেয় না। ছেঁড়া বোরকা হতে পারে, রং জ্বলে যাওয়া হিজাব হতে পারে, কিন্তু তা তাদের শালীনতাকে ঢেকে রাখে ইস্পাত কঠিন আবরণে। আমরা অভুক্ত থাকতে রাজি, কিন্তু পরিবারের ইজ্জত নিলামে তুলতে রাজি নই। আধুনিকতা বা প্রগতির নামে বেহায়াপনা আমাদের ঘরে ঢুকতে পারে না।
কারণ, আমরা জানি, দাইয়ুস (যে তার পরিবারের অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয়) জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আমাদের ঘরগুলো ছোট, আসবাবপত্র নড়বড়ে, কিন্তু সেখানে কোরআনের তেলাওয়াত হয়, রাসুলের সিরাত চর্চা হয়। এটাই আমাদের ঐশ্বর্য।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে সবাইকে ধনী বানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করেন, আর কাউকে না দিয়ে। ধনীদের পরীক্ষা হলো তারা শুকরিয়া আদায় করে কি না এবং গরিবের হক দেয় কি না।
আর আমাদের পরীক্ষা হলো আমরা সবর করি কি না এবং হালাল পথে থাকি কি না। হাদিসে এসেছে,
“গরিবরা ধনীদের ৫০০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
এই একটি হাদিস আমাদের সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। ৫০০ বছর! ভাবা যায়? যখন ধনীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিতে দিতে ঘর্মাক্ত হবে, তখন আমরা হয়তো জান্নাতের বাগিচায় ঘুরে বেড়াব। এই আশাই আমাদের চালিকাশক্তি।
এই দুনিয়ার ৬০-৭০ বছরের জীবনটা সেই অনন্তকালের তুলনায় চোখের পলক ফেলার মতো সময়ও নয়। তাই এই সামান্য সময়ের কষ্টকে আমরা হাসিমুখে বরণ করে নিই।
তবুও, আমরা মানুষ। আমাদেরও কষ্ট হয়। যখন দেখি মেধা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে আমাদের সন্তান ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারছে না, তখন বুকটা ফেটে যায়।
যখন দেখি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ঘুষ দিতে না পারার কারণে চাকরিটা হচ্ছে না, তখন হতাশা গ্রাস করতে চায়। তখন আমরা সেজদায় লুটিয়ে পড়ি। আল্লাহর কাছে নালিশ করি। বলি,
“হে আল্লাহ! তুমি তো রাজাধিরাজ। তোমার তো ভাণ্ডারের অভাব নেই। আমাদের এই পরীক্ষা আর কতদিন?”
চোখের পানিতে জায়নামাজ ভিজে যায়। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সেই কান্নার পরেই মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসে। মনে হয়, আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছেন। তিনি হয়তো দুনিয়াতে দেবেন না, কিন্তু এর উত্তম প্রতিদান তিনি জমা রেখেছেন।
অথবা তিনি আমাদের এমন কোনো বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, যা আমরা জানি না। এই তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসাই আমাদের একমাত্র সম্বল।
আমাদের সমাজে হালাল ও হারামের সংমিশ্রণ এখন এতটাই প্রবল যে, হালালভাবে টিকে থাকাটা জ্বলন্ত কয়লা হাতে রাখার মতো। কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি পদে পদে অফার আসে—
“একটু সই করে দিন, মোটা অংক পাবেন।”
“একটু চোখ বন্ধ রাখুন, প্রমোশন হবে।”
এই প্রলোভনগুলো সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের গাইরত বা আত্মসম্মানবোধ সেখানে বাঁধ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা ভাবি, যে হাতে আজ হারাম টাকা নেব, কাল হাশরের ময়দানে সেই হাতই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। আমার চামড়া, আমার চোখ, আমার কান—সবাই সেদিন কথা বলবে। তখন আমি কোথায় পালাব?
এই জবাবদিহিতার ভয় আমাদের অসৎ হতে দেয় না। আমরা বোকা হতে পারি, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা ‘ব্যাকডেটেড’ মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমরা আখেরাত হারানো দেউলিয়া হতে চাই না।
আমরা যারা নিম্নবিত্ত, আমাদের জীবনটা কোনো উপন্যাসের পাতা নয়, এটা নির্মম বাস্তব। কিন্তু এই বাস্তবের মাঝেও আমরা এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। আমাদের জগৎটা বিশ্বাসের, আমাদের জগৎটা ভালোবাসার। আমরা অল্পতে খুশি হই, অল্পতে হাসি। এক বেলা ভালো খাবার জুটলে আমরা আল্লাহর শুকরিয়ায় নত হই। আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।
কারণ, আমরা জানি, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদেরই বেশি কষ্টে রাখেন, যাতে তারা তাকে ভুলে না যায়। আমাদের এই অভাব আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি রাখে। এটাই আমাদের বড় পাওয়া।
আমরা গাইরত ধরে রেখেছি, কারণ আমরা জানি, ইজ্জত আল্লাহর দান। টাকা দিয়ে ইজ্জত কেনা যায় না। অনেক কোটিপতি আছে, যাদের মানুষ ঘৃণা করে। আবার অনেক রিকশাচালক আছে, যাদের মানুষ সালাম দেয়, সম্মান করে তাদের সততার জন্য। আমরা সেই সম্মানের কাঙ্গাল।
আমরা চাই, আমাদের মৃত্যুর পর মানুষ বলুক,
“লোকটা গরিব ছিল, কিন্তু সৎ ছিল।”
এটুকুই আমাদের দুনিয়ার অর্জন। আর আখেরাতের অর্জন তো আল্লাহর জিম্মায়। সুতরাং, হে আমার নিম্নবিত্ত ভাই ও বোনেরা! আপনারা যারা সততার সাথে, কষ্টের সাথে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, আপনারা হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না। আপনারা সমাজের বোঝা নন, আপনারা সমাজের বিবেক।
আপনারা আছেন বলেই এখনো আসমান থেকে গজব নাজিল হয় না। আপনাদের চোখের পানির অনেক দাম আল্লাহর কাছে। আপনারা আপনাদের ঈমান ও গাইরতকে আঁকড়ে ধরে রাখুন। এই অন্ধকার রাত কেটে যাবেই। ভোরের আলো আসবেই। সেই ভোর হয়তো দুনিয়াতে আসবে না, কিন্তু মৃত্যুর ঠিক ওপারেই এক সোনালী ভোর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে কোনো অভাব নেই, কোনো ক্ষুধা নেই, কোনো অপমান নেই। সেখানে শুধু শান্তি আর শান্তি।
আমাদের এই জীর্ণ কুঁড়েঘর একদিন জান্নাতের প্রাসাদে রূপান্তরিত হবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের এই তালি দেওয়া জামা একদিন রেশমি পোশাকে বদলে যাবে। আমাদের এই ক্ষুধার্ত পেট সেদিন জান্নাতি খাবারে তৃপ্ত হবে। শুধু সেই দিনটির অপেক্ষায় আমরা আছি।
ততক্ষণ পর্যন্ত, আসুন আমরা আমাদের গাইরত, আমাদের হালাল-হারামের বোধ এবং আমাদের ঈমানকে বুকের ভেতর আগলে রাখি। দুনিয়া যা খুশি ভাবুক, আমরা তো জানি— আমরা আল্লাহর দলের লোক। আর আল্লাহর দলই চূড়ান্ত বিজয়ী। এই বিশ্বাসই আমাদের বাঁচিয়ে রাখুক, আমৃত্যু।
[যে ঈমান অভাবকে করে ঐশ্বর্যময়]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
জীর্ণ এক চালের নিচে আমাদের বসবাস। রোদের তীব্রতা আর বৃষ্টির ছাট—উভয়ই আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। শহরের নোনা ধরা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের কাতারে হয়তো আমাদের নাম সবার আগে। লোকে আমাদের বলে নিম্নবিত্ত, কেউবা করুণার চোখে তাকায়, আবার কেউবা অবজ্ঞার।
কিন্তু এই জীর্ণ পোশাক আর অভাবের সংসারের ভেতরেও এমন এক অদৃশ্য সম্পদ আমাদের আছে, যা বড় বড় অট্টালিকার বাসিন্দাদের সিন্দুক হাতড়ালেও মিলবে না। সেই সম্পদ হলো ‘গাইরত’ বা আত্মমর্যাদাবোধ এবং হালাল-হারামের সুতীব্র চেতনা।
আমাদের পকেট হয়তো অধিকাংশ সময় শূন্য থাকে, মাস ফুরোলে দীর্ঘশ্বাসের শব্দে বাতাস ভারী হয়, কিন্তু আমাদের হৃদয়ের প্রশান্তিটুকু এক মহাসমুদ্রের মতো গভীর।
আমরা জানি, অভাবের তাড়নায় পেট পুড়লেও, হারামের এক লোকমা খাবার দিয়ে সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করা মানে পরকালের অনন্ত আগুনকে নিজের পেটে ধারণ করা। এই বোধটুকু আমাদের ধমনীতে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়।
পৃথিবীটা এখন বড় অদ্ভুত। এখানে যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত হয় ব্যাংকের অংক আর গাড়ির মডেলে। কিন্তু আমরা যারা মাটির কাছাকাছি থাকি, আমরা জীবনকে দেখি ভিন্ন এক প্রিজমে। আমাদের কাছে জীবনের সার্থকতা ভোগে নয়, বরং ত্যাগে এবং পবিত্রতায়।
বলতে হয়— আধুনিকতা আমাদের শিখিয়েছে ‘মোর ইজ বেটার’, কিন্তু আমাদের ঈমান শেখায় ‘পিওর ইজ বেটার’। অল্প হোক, কিন্তু তা যেন স্বচ্ছ ঝর্ণার মতো পবিত্র হয়।
সকালবেলা যখন একজন নিম্নবিত্ত বাবা কাজের সন্ধানে বের হন, তার পায়ে হয়তো তালি দেওয়া জুতো, কিন্তু তার কপালে সেজদার দাগ। তিনি জানেন, দিনশেষে তাকে খালি হাতে ফিরতে হতে পারে, কিন্তু তিনি এও জানেন যে, অসদুপায়ে অর্জিত বিরিয়ানির চেয়ে ঘাম ঝরানো উপার্জনের নুন-ভাত অনেক বেশি তৃপ্তিদায়ক।
এই তৃপ্তিটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, এটা আসে ওপরওয়ালার পক্ষ থেকে। এটা হলো সেই প্রশান্তি, যা আল্লাহ কেবল তাঁর প্রিয় বান্দাদের কালবে নাজিল করেন।
মুমিনের জন্য দুনিয়াটা তো জেলখানা। জেলখানায় কেউ আয়েশ করতে আসে না, এখানে নিয়ম মানতে হয়। আমাদের এই অভাব, এই টানাটানি—এগুলো তো সেই পরীক্ষারই অংশ। আমরা যখন দেখি, চারপাশের মানুষ সুদের কারবার করে চোখের পলকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে, ঘুষের টাকায় আকাশচুম্বী বাড়ি বানাচ্ছে, তখন আমাদের নফস যে ধোঁকা খায় না, তা নয়। শয়তান এসে ফিসফিস করে বলে,
“একবারই তো! সবাই তো করছে, তুমি করলে দোষ কী?”
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের গাইরত জেগে ওঠে। মনে পড়ে যায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেই হাদিসটি, যেখানে তিনি বলেছেন,
“যে শরীর হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”
এই একটি বাক্য আমাদের শিরদাঁড়া সোজা করে দেয়। আমরা ভাবি, যে শরীরের জন্য এত আয়োজন, তা তো কদিন পর মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু রুহ? তার কী হবে? ক্ষণিকের সুখের জন্য অনন্তকালের বিনাশ আমরা সইতে পারব না।
আমাদের ঘরের চিত্রগুলো বড় মায়াময়, আবার বড় করুণ। ঈদের সময় হয়তো সন্তানের আবদার মেটানো সম্ভব হয় না। পাশের বাসার ছেলেটি যখন নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়ায়, আমাদের সন্তান তখন পুরনো জামাটাকেই ধুয়ে ইস্ত্রি করে পরে। এই দৃশ্য বাবার বুকে শেল বিঁধিয়ে দেয়, মায়ের চোখের কোণে পানি জমায়। কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানদের শেখাই—
“বাবা, আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু আমরা ভিখারি নই। আমরা আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে হাত পাতি না।”
এই যে ছোটবেলা থেকেই হালাল-হারামের বীজটা তাদের মনে বুনে দেওয়া, এটাই আমাদের আসল উত্তরাধিকার।
আমাদের সন্তানরা হয়তো দামী খেলনা পায় না, কিন্তু তারা পায় সততার শিক্ষা। তারা দেখে, বাবা ক্ষুধার্ত থেকেও অন্যের হক মারে না। মা ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করে পরে, তবুও বাবার ওপর অন্যায্য আয়ের চাপ দেয় না। এই যে নীরব তারবিয়াত, এটা কোনো স্কুল-কলেজে শেখানো হয় না। এটা আমাদের কুঁড়েঘরের মাদ্রাসা থেকে অর্জিত।
বাস্তবতা বড় কঠিন। বাজারে গেলে যখন দ্রব্যমূল্যের আগুনে হাত পুড়ে যায়, তখন অসহায় লাগে। পকেটের পয়সা গুনে যখন চালের বদলে খুদ কিনতে হয়, তখন দীর্ঘশ্বাস বের হয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে খন্দকের যুদ্ধের কথা।
মনে পড়ে, জগতবাসীর শ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সা.)-এর পেটে পাথর বাঁধার দৃশ্য। তিনি কি পারতেন না উহুদ পাহাড়কে সোনা বানিয়ে দিতে? আল্লাহ তো তাকে সেই প্রস্তাবই দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন অভাব আর সবরের জীবন।
আমরা সেই নবীর উম্মত। আমাদের অভাব দেখে যারা উপহাস করে, তারা জানে না যে, আমরা আসলে নববীয়তের এক কঠিন সুন্নতের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
অভাব আমাদের লজ্জিত করে না, বরং আমাদের অহংকারী হওয়া থেকে বাঁচায়। ধন-সম্পদ মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে, আর অভাব মানুষকে রবের দরজায় নত রাখে। আমরা এই নত থাকাটাকেই আমাদের শক্তি মনে করি।
সমাজের তথাকথিত ‘স্ট্যাটাস’ মেইনটেইন করতে গিয়ে কত মানুষ যে নিজের আত্মসম্মান, ইজ্জত বিক্রি করে দিচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। তারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে, সুদের কিস্তি শোধ করতে গিয়ে রাতের ঘুম হারাম করছে। অথচ আমরা?
আমাদের হয়তো এসি নেই, ফ্যানটাও মাঝে মাঝে শব্দ করে, কিন্তু বালিশে মাথা রাখলে আমাদের সাথে সাথে ঘুম চলে আসে। কারণ, আমাদের ঘাড়ে কোনো জুলুমের বোঝা নেই। কারো অভিশাপ আমাদের তাড়া করে না। এই যে নির্ভার জীবন, এটা কি কোটি টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব?
কখনোই না। গাইরত বা আত্মমর্যাদা হলো এমন এক ঢাল, যা আমাদের অন্যের সামনে মাথা নত করতে দেয় না। আমরা জানি, রিযিকদাতা একমাত্র আল্লাহ। বসের তোষামোদ করে বা অন্যায়ের সাথে আপোষ করে রিযিক বাড়ে না, বরং রিযিক থেকে বরকত উঠে যায়। আমরা বরকতহীন প্রাচুর্যের চেয়ে বরকতময় অভাবকে হাজার গুণ শ্রেয় মনে করি।
হালাল উপার্জন যে কতটা কঠিন, তা কেবল ভুক্তভোগীই জানে। রিকশাচালক ভাইটি যখন প্রখর রোদে প্যাডেল ঘোরান, কিংবা গার্মেন্টস কর্মী বোনটি যখন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন—তাদের সেই ঘামের ফোঁটাগুলো আল্লাহর কাছে শহীদদের রক্তের মতোই পবিত্র হতে পারে, যদি নিয়ত ঠিক থাকে।
আমাদের সমাজের অনেকেই মনে করে, ইবাদত মানে কেবল নামাজ আর রোজা। কিন্তু হালাল রুজির সন্ধানে বের হওয়াটাও যে এক প্রকার জিহাদ, তা আমরা ভুলে যাই। আমরা নিম্নবিত্তরা এই জিহাদের ময়দানের সিপাহী। আমাদের যুদ্ধটা নফসের বিরুদ্ধে, লোভের বিরুদ্ধে।
অফিসে যখন ফাইল আটকে উপরি কামানোর সুযোগ আসে, তখন সেই সুযোগ পায়ে ঠেলে দেওয়াটা তাহাজ্জুদের চেয়ে কম ফজিলতপূর্ণ নয়। কারণ, হারাম বর্জন করা ফরয। আর এই ফরয আদায় করতে গিয়েই আমাদের সংসার চলে ধুঁকে ধুঁকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই ধুঁকে ধুঁকে চলার মাঝেও এক অলৌকিক আনন্দ আছে। সেই আনন্দ হলো বিজয়ের আনন্দ—শয়তানকে পরাজিত করার আনন্দ।
মাঝে মাঝে আমাদের স্ত্রী-কন্যারাও ধৈর্যের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করে। তারা দেখে, প্রতিবেশীর ঘরে নতুন ফার্নিচার আসছে, দামি শাড়ি আসছে। তাদেরও মন চায়। তারা তো মানুষ। কিন্তু যখনই তারা স্বামীর মলিন মুখটা দেখে, স্বামীর হালাল উপার্জনের কষ্টের কথা ভাবে, তখন তারা নিজেদের ইচ্ছেগুলোকে দাফন করে ফেলে। তারা বলে,
“আমাদের যা আছে, তাতেই চলবে।”
এই যে ‘কানাআত’ বা অল্পে তুষ্টি—এটা জান্নাতের গুপ্তধন। এই গুণটি আমাদের মা-বোনদের রানীর মর্যাদায় আসীন করেছে। তারা দুনিয়ার চাকচিক্য চায় না, তারা চায় পরকালের মুক্তি। তারা জানে, দুনিয়াটা ক্ষণস্থায়ী মুসাফিরখানা। এখানে খুব বেশি সাজগোজ করার মানে নেই। আসল বাড়ি তো ওপারে। সেখানে আল্লাহ আমাদের জন্য এমন প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হবে। সেই আশায় বুক বেঁধেই আমরা দুনিয়ার এই কষ্টের দিনগুলো পার করি।
আমরা যখন অসুস্থ হই, তখন দামী হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য আমাদের থাকে না। সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে কাতরাতে হয়। ওষুধের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে হয়তো শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করতে হয়। তবুও আমরা সুদের ওপর টাকা ধার করি না। কারণ, আল্লাহ বলেছেন,
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।”
আমরা মরে যাব, তবুও আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করব না। সুদ খাওয়া মানে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করা। আমরা দুর্বল বান্দা, আমরা কি আমাদের স্রষ্টার সাথে যুদ্ধ করে টিকতে পারব? এই ভয়টা আমাদের অন্তরে গেঁথে আছে।
তাই চিকিৎসা না পেয়ে ধুঁকে মরাটাকেও আমরা পরীক্ষার অংশ হিসেবে মেনে নিই। আমরা বিশ্বাস করি, রোগের মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনের গুনাহ মাফ করে দেন। প্রতিটি ব্যথার বিনিময়ে আমাদের আমলনামায় সওয়াব লেখা হচ্ছে। এই বিশ্বাসই আমাদের পেইনকিলার, এই বিশ্বাসই আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
আমাদের গাইরত শুধু টাকার অংকেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের নারীদের পর্দার ব্যাপারেও আমরা আপোষহীন। অভাবের তাড়নায় আমাদের মা-বোনেরা হয়তো বাইরে কাজ করে, কিন্তু তারা তাদের সম্ভ্রম বিসর্জন দেয় না। ছেঁড়া বোরকা হতে পারে, রং জ্বলে যাওয়া হিজাব হতে পারে, কিন্তু তা তাদের শালীনতাকে ঢেকে রাখে ইস্পাত কঠিন আবরণে। আমরা অভুক্ত থাকতে রাজি, কিন্তু পরিবারের ইজ্জত নিলামে তুলতে রাজি নই। আধুনিকতা বা প্রগতির নামে বেহায়াপনা আমাদের ঘরে ঢুকতে পারে না।
কারণ, আমরা জানি, দাইয়ুস (যে তার পরিবারের অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয়) জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আমাদের ঘরগুলো ছোট, আসবাবপত্র নড়বড়ে, কিন্তু সেখানে কোরআনের তেলাওয়াত হয়, রাসুলের সিরাত চর্চা হয়। এটাই আমাদের ঐশ্বর্য।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে সবাইকে ধনী বানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করেন, আর কাউকে না দিয়ে। ধনীদের পরীক্ষা হলো তারা শুকরিয়া আদায় করে কি না এবং গরিবের হক দেয় কি না।
আর আমাদের পরীক্ষা হলো আমরা সবর করি কি না এবং হালাল পথে থাকি কি না। হাদিসে এসেছে,
“গরিবরা ধনীদের ৫০০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
এই একটি হাদিস আমাদের সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। ৫০০ বছর! ভাবা যায়? যখন ধনীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিতে দিতে ঘর্মাক্ত হবে, তখন আমরা হয়তো জান্নাতের বাগিচায় ঘুরে বেড়াব। এই আশাই আমাদের চালিকাশক্তি।
এই দুনিয়ার ৬০-৭০ বছরের জীবনটা সেই অনন্তকালের তুলনায় চোখের পলক ফেলার মতো সময়ও নয়। তাই এই সামান্য সময়ের কষ্টকে আমরা হাসিমুখে বরণ করে নিই।
তবুও, আমরা মানুষ। আমাদেরও কষ্ট হয়। যখন দেখি মেধা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে আমাদের সন্তান ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারছে না, তখন বুকটা ফেটে যায়।
যখন দেখি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ঘুষ দিতে না পারার কারণে চাকরিটা হচ্ছে না, তখন হতাশা গ্রাস করতে চায়। তখন আমরা সেজদায় লুটিয়ে পড়ি। আল্লাহর কাছে নালিশ করি। বলি,
“হে আল্লাহ! তুমি তো রাজাধিরাজ। তোমার তো ভাণ্ডারের অভাব নেই। আমাদের এই পরীক্ষা আর কতদিন?”
চোখের পানিতে জায়নামাজ ভিজে যায়। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সেই কান্নার পরেই মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসে। মনে হয়, আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছেন। তিনি হয়তো দুনিয়াতে দেবেন না, কিন্তু এর উত্তম প্রতিদান তিনি জমা রেখেছেন।
অথবা তিনি আমাদের এমন কোনো বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, যা আমরা জানি না। এই তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসাই আমাদের একমাত্র সম্বল।
আমাদের সমাজে হালাল ও হারামের সংমিশ্রণ এখন এতটাই প্রবল যে, হালালভাবে টিকে থাকাটা জ্বলন্ত কয়লা হাতে রাখার মতো। কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি পদে পদে অফার আসে—
“একটু সই করে দিন, মোটা অংক পাবেন।”
“একটু চোখ বন্ধ রাখুন, প্রমোশন হবে।”
এই প্রলোভনগুলো সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের গাইরত বা আত্মসম্মানবোধ সেখানে বাঁধ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা ভাবি, যে হাতে আজ হারাম টাকা নেব, কাল হাশরের ময়দানে সেই হাতই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। আমার চামড়া, আমার চোখ, আমার কান—সবাই সেদিন কথা বলবে। তখন আমি কোথায় পালাব?
এই জবাবদিহিতার ভয় আমাদের অসৎ হতে দেয় না। আমরা বোকা হতে পারি, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা ‘ব্যাকডেটেড’ মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমরা আখেরাত হারানো দেউলিয়া হতে চাই না।
আমরা যারা নিম্নবিত্ত, আমাদের জীবনটা কোনো উপন্যাসের পাতা নয়, এটা নির্মম বাস্তব। কিন্তু এই বাস্তবের মাঝেও আমরা এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। আমাদের জগৎটা বিশ্বাসের, আমাদের জগৎটা ভালোবাসার। আমরা অল্পতে খুশি হই, অল্পতে হাসি। এক বেলা ভালো খাবার জুটলে আমরা আল্লাহর শুকরিয়ায় নত হই। আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।
কারণ, আমরা জানি, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদেরই বেশি কষ্টে রাখেন, যাতে তারা তাকে ভুলে না যায়। আমাদের এই অভাব আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি রাখে। এটাই আমাদের বড় পাওয়া।
আমরা গাইরত ধরে রেখেছি, কারণ আমরা জানি, ইজ্জত আল্লাহর দান। টাকা দিয়ে ইজ্জত কেনা যায় না। অনেক কোটিপতি আছে, যাদের মানুষ ঘৃণা করে। আবার অনেক রিকশাচালক আছে, যাদের মানুষ সালাম দেয়, সম্মান করে তাদের সততার জন্য। আমরা সেই সম্মানের কাঙ্গাল।
আমরা চাই, আমাদের মৃত্যুর পর মানুষ বলুক,
“লোকটা গরিব ছিল, কিন্তু সৎ ছিল।”
এটুকুই আমাদের দুনিয়ার অর্জন। আর আখেরাতের অর্জন তো আল্লাহর জিম্মায়। সুতরাং, হে আমার নিম্নবিত্ত ভাই ও বোনেরা! আপনারা যারা সততার সাথে, কষ্টের সাথে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, আপনারা হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না। আপনারা সমাজের বোঝা নন, আপনারা সমাজের বিবেক।
আপনারা আছেন বলেই এখনো আসমান থেকে গজব নাজিল হয় না। আপনাদের চোখের পানির অনেক দাম আল্লাহর কাছে। আপনারা আপনাদের ঈমান ও গাইরতকে আঁকড়ে ধরে রাখুন। এই অন্ধকার রাত কেটে যাবেই। ভোরের আলো আসবেই। সেই ভোর হয়তো দুনিয়াতে আসবে না, কিন্তু মৃত্যুর ঠিক ওপারেই এক সোনালী ভোর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে কোনো অভাব নেই, কোনো ক্ষুধা নেই, কোনো অপমান নেই। সেখানে শুধু শান্তি আর শান্তি।
আমাদের এই জীর্ণ কুঁড়েঘর একদিন জান্নাতের প্রাসাদে রূপান্তরিত হবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের এই তালি দেওয়া জামা একদিন রেশমি পোশাকে বদলে যাবে। আমাদের এই ক্ষুধার্ত পেট সেদিন জান্নাতি খাবারে তৃপ্ত হবে। শুধু সেই দিনটির অপেক্ষায় আমরা আছি।
ততক্ষণ পর্যন্ত, আসুন আমরা আমাদের গাইরত, আমাদের হালাল-হারামের বোধ এবং আমাদের ঈমানকে বুকের ভেতর আগলে রাখি। দুনিয়া যা খুশি ভাবুক, আমরা তো জানি— আমরা আল্লাহর দলের লোক। আর আল্লাহর দলই চূড়ান্ত বিজয়ী। এই বিশ্বাসই আমাদের বাঁচিয়ে রাখুক, আমৃত্যু।
[যে ঈমান অভাবকে করে ঐশ্বর্যময়]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Comment
Share
Send as a message
Share on my page
Share in the group



