UMMA TOKEN INVESTOR

About me

"I am my own self — a journey full of flaws and imperfections. Yet I strive to let every shadow of my being be colored by the light of the Prophet (ﷺ)." — Saeed.

Followings
0
No followings
Translation is not possible.
জীর্ণ এক চালের নিচে আমাদের বসবাস। রোদের তীব্রতা আর বৃষ্টির ছাট—উভয়ই আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। শহরের নোনা ধরা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের কাতারে হয়তো আমাদের নাম সবার আগে। লোকে আমাদের বলে নিম্নবিত্ত, কেউবা করুণার চোখে তাকায়, আবার কেউবা অবজ্ঞার।
কিন্তু এই জীর্ণ পোশাক আর অভাবের সংসারের ভেতরেও এমন এক অদৃশ্য সম্পদ আমাদের আছে, যা বড় বড় অট্টালিকার বাসিন্দাদের সিন্দুক হাতড়ালেও মিলবে না। সেই সম্পদ হলো ‘গাইরত’ বা আত্মমর্যাদাবোধ এবং হালাল-হারামের সুতীব্র চেতনা।
আমাদের পকেট হয়তো অধিকাংশ সময় শূন্য থাকে, মাস ফুরোলে দীর্ঘশ্বাসের শব্দে বাতাস ভারী হয়, কিন্তু আমাদের হৃদয়ের প্রশান্তিটুকু এক মহাসমুদ্রের মতো গভীর।
আমরা জানি, অভাবের তাড়নায় পেট পুড়লেও, হারামের এক লোকমা খাবার দিয়ে সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করা মানে পরকালের অনন্ত আগুনকে নিজের পেটে ধারণ করা। এই বোধটুকু আমাদের ধমনীতে রক্তের মতো প্রবাহিত হয়।
​পৃথিবীটা এখন বড় অদ্ভুত। এখানে যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত হয় ব্যাংকের অংক আর গাড়ির মডেলে। কিন্তু আমরা যারা মাটির কাছাকাছি থাকি, আমরা জীবনকে দেখি ভিন্ন এক প্রিজমে। আমাদের কাছে জীবনের সার্থকতা ভোগে নয়, বরং ত্যাগে এবং পবিত্রতায়।
বলতে হয়— আধুনিকতা আমাদের শিখিয়েছে ‘মোর ইজ বেটার’, কিন্তু আমাদের ঈমান শেখায় ‘পিওর ইজ বেটার’। অল্প হোক, কিন্তু তা যেন স্বচ্ছ ঝর্ণার মতো পবিত্র হয়।
সকালবেলা যখন একজন নিম্নবিত্ত বাবা কাজের সন্ধানে বের হন, তার পায়ে হয়তো তালি দেওয়া জুতো, কিন্তু তার কপালে সেজদার দাগ। তিনি জানেন, দিনশেষে তাকে খালি হাতে ফিরতে হতে পারে, কিন্তু তিনি এও জানেন যে, অসদুপায়ে অর্জিত বিরিয়ানির চেয়ে ঘাম ঝরানো উপার্জনের নুন-ভাত অনেক বেশি তৃপ্তিদায়ক।
এই তৃপ্তিটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, এটা আসে ওপরওয়ালার পক্ষ থেকে। এটা হলো সেই প্রশান্তি, যা আল্লাহ কেবল তাঁর প্রিয় বান্দাদের কালবে নাজিল করেন।
​মুমিনের জন্য দুনিয়াটা তো জেলখানা। জেলখানায় কেউ আয়েশ করতে আসে না, এখানে নিয়ম মানতে হয়। আমাদের এই অভাব, এই টানাটানি—এগুলো তো সেই পরীক্ষারই অংশ। আমরা যখন দেখি, চারপাশের মানুষ সুদের কারবার করে চোখের পলকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে, ঘুষের টাকায় আকাশচুম্বী বাড়ি বানাচ্ছে, তখন আমাদের নফস যে ধোঁকা খায় না, তা নয়। শয়তান এসে ফিসফিস করে বলে,
“একবারই তো! সবাই তো করছে, তুমি করলে দোষ কী?”
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের গাইরত জেগে ওঠে। মনে পড়ে যায় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেই হাদিসটি, যেখানে তিনি বলেছেন,
“যে শরীর হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”
এই একটি বাক্য আমাদের শিরদাঁড়া সোজা করে দেয়। আমরা ভাবি, যে শরীরের জন্য এত আয়োজন, তা তো কদিন পর মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু রুহ? তার কী হবে? ক্ষণিকের সুখের জন্য অনন্তকালের বিনাশ আমরা সইতে পারব না।
​আমাদের ঘরের চিত্রগুলো বড় মায়াময়, আবার বড় করুণ। ঈদের সময় হয়তো সন্তানের আবদার মেটানো সম্ভব হয় না। পাশের বাসার ছেলেটি যখন নতুন জামা পরে ঘুরে বেড়ায়, আমাদের সন্তান তখন পুরনো জামাটাকেই ধুয়ে ইস্ত্রি করে পরে। এই দৃশ্য বাবার বুকে শেল বিঁধিয়ে দেয়, মায়ের চোখের কোণে পানি জমায়। কিন্তু আমরা আমাদের সন্তানদের শেখাই—
“বাবা, আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু আমরা ভিখারি নই। আমরা আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে হাত পাতি না।”
এই যে ছোটবেলা থেকেই হালাল-হারামের বীজটা তাদের মনে বুনে দেওয়া, এটাই আমাদের আসল উত্তরাধিকার।
আমাদের সন্তানরা হয়তো দামী খেলনা পায় না, কিন্তু তারা পায় সততার শিক্ষা। তারা দেখে, বাবা ক্ষুধার্ত থেকেও অন্যের হক মারে না। মা ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করে পরে, তবুও বাবার ওপর অন্যায্য আয়ের চাপ দেয় না। এই যে নীরব তারবিয়াত, এটা কোনো স্কুল-কলেজে শেখানো হয় না। এটা আমাদের কুঁড়েঘরের মাদ্রাসা থেকে অর্জিত।
​বাস্তবতা বড় কঠিন। বাজারে গেলে যখন দ্রব্যমূল্যের আগুনে হাত পুড়ে যায়, তখন অসহায় লাগে। পকেটের পয়সা গুনে যখন চালের বদলে খুদ কিনতে হয়, তখন দীর্ঘশ্বাস বের হয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে খন্দকের যুদ্ধের কথা।
মনে পড়ে, জগতবাসীর শ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সা.)-এর পেটে পাথর বাঁধার দৃশ্য। তিনি কি পারতেন না উহুদ পাহাড়কে সোনা বানিয়ে দিতে? আল্লাহ তো তাকে সেই প্রস্তাবই দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন অভাব আর সবরের জীবন।
আমরা সেই নবীর উম্মত। আমাদের অভাব দেখে যারা উপহাস করে, তারা জানে না যে, আমরা আসলে নববীয়তের এক কঠিন সুন্নতের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
অভাব আমাদের লজ্জিত করে না, বরং আমাদের অহংকারী হওয়া থেকে বাঁচায়। ধন-সম্পদ মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে, আর অভাব মানুষকে রবের দরজায় নত রাখে। আমরা এই নত থাকাটাকেই আমাদের শক্তি মনে করি।
​সমাজের তথাকথিত ‘স্ট্যাটাস’ মেইনটেইন করতে গিয়ে কত মানুষ যে নিজের আত্মসম্মান, ইজ্জত বিক্রি করে দিচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। তারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে, সুদের কিস্তি শোধ করতে গিয়ে রাতের ঘুম হারাম করছে। অথচ আমরা?
আমাদের হয়তো এসি নেই, ফ্যানটাও মাঝে মাঝে শব্দ করে, কিন্তু বালিশে মাথা রাখলে আমাদের সাথে সাথে ঘুম চলে আসে। কারণ, আমাদের ঘাড়ে কোনো জুলুমের বোঝা নেই। কারো অভিশাপ আমাদের তাড়া করে না। এই যে নির্ভার জীবন, এটা কি কোটি টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব?
কখনোই না। গাইরত বা আত্মমর্যাদা হলো এমন এক ঢাল, যা আমাদের অন্যের সামনে মাথা নত করতে দেয় না। আমরা জানি, রিযিকদাতা একমাত্র আল্লাহ। বসের তোষামোদ করে বা অন্যায়ের সাথে আপোষ করে রিযিক বাড়ে না, বরং রিযিক থেকে বরকত উঠে যায়। আমরা বরকতহীন প্রাচুর্যের চেয়ে বরকতময় অভাবকে হাজার গুণ শ্রেয় মনে করি।
​হালাল উপার্জন যে কতটা কঠিন, তা কেবল ভুক্তভোগীই জানে। রিকশাচালক ভাইটি যখন প্রখর রোদে প্যাডেল ঘোরান, কিংবা গার্মেন্টস কর্মী বোনটি যখন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটেন—তাদের সেই ঘামের ফোঁটাগুলো আল্লাহর কাছে শহীদদের রক্তের মতোই পবিত্র হতে পারে, যদি নিয়ত ঠিক থাকে।
আমাদের সমাজের অনেকেই মনে করে, ইবাদত মানে কেবল নামাজ আর রোজা। কিন্তু হালাল রুজির সন্ধানে বের হওয়াটাও যে এক প্রকার জিহাদ, তা আমরা ভুলে যাই। আমরা নিম্নবিত্তরা এই জিহাদের ময়দানের সিপাহী। আমাদের যুদ্ধটা নফসের বিরুদ্ধে, লোভের বিরুদ্ধে।
অফিসে যখন ফাইল আটকে উপরি কামানোর সুযোগ আসে, তখন সেই সুযোগ পায়ে ঠেলে দেওয়াটা তাহাজ্জুদের চেয়ে কম ফজিলতপূর্ণ নয়। কারণ, হারাম বর্জন করা ফরয। আর এই ফরয আদায় করতে গিয়েই আমাদের সংসার চলে ধুঁকে ধুঁকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই ধুঁকে ধুঁকে চলার মাঝেও এক অলৌকিক আনন্দ আছে। সেই আনন্দ হলো বিজয়ের আনন্দ—শয়তানকে পরাজিত করার আনন্দ।
​মাঝে মাঝে আমাদের স্ত্রী-কন্যারাও ধৈর্যের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করে। তারা দেখে, প্রতিবেশীর ঘরে নতুন ফার্নিচার আসছে, দামি শাড়ি আসছে। তাদেরও মন চায়। তারা তো মানুষ। কিন্তু যখনই তারা স্বামীর মলিন মুখটা দেখে, স্বামীর হালাল উপার্জনের কষ্টের কথা ভাবে, তখন তারা নিজেদের ইচ্ছেগুলোকে দাফন করে ফেলে। তারা বলে,
“আমাদের যা আছে, তাতেই চলবে।”
এই যে ‘কানাআত’ বা অল্পে তুষ্টি—এটা জান্নাতের গুপ্তধন। এই গুণটি আমাদের মা-বোনদের রানীর মর্যাদায় আসীন করেছে। তারা দুনিয়ার চাকচিক্য চায় না, তারা চায় পরকালের মুক্তি। তারা জানে, দুনিয়াটা ক্ষণস্থায়ী মুসাফিরখানা। এখানে খুব বেশি সাজগোজ করার মানে নেই। আসল বাড়ি তো ওপারে। সেখানে আল্লাহ আমাদের জন্য এমন প্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন, যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হবে। সেই আশায় বুক বেঁধেই আমরা দুনিয়ার এই কষ্টের দিনগুলো পার করি।
​আমরা যখন অসুস্থ হই, তখন দামী হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য আমাদের থাকে না। সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে কাতরাতে হয়। ওষুধের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে হয়তো শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করতে হয়। তবুও আমরা সুদের ওপর টাকা ধার করি না। কারণ, আল্লাহ বলেছেন,
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।”
আমরা মরে যাব, তবুও আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করব না। সুদ খাওয়া মানে আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করা। আমরা দুর্বল বান্দা, আমরা কি আমাদের স্রষ্টার সাথে যুদ্ধ করে টিকতে পারব? এই ভয়টা আমাদের অন্তরে গেঁথে আছে।
তাই চিকিৎসা না পেয়ে ধুঁকে মরাটাকেও আমরা পরীক্ষার অংশ হিসেবে মেনে নিই। আমরা বিশ্বাস করি, রোগের মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনের গুনাহ মাফ করে দেন। প্রতিটি ব্যথার বিনিময়ে আমাদের আমলনামায় সওয়াব লেখা হচ্ছে। এই বিশ্বাসই আমাদের পেইনকিলার, এই বিশ্বাসই আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
​আমাদের গাইরত শুধু টাকার অংকেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের নারীদের পর্দার ব্যাপারেও আমরা আপোষহীন। অভাবের তাড়নায় আমাদের মা-বোনেরা হয়তো বাইরে কাজ করে, কিন্তু তারা তাদের সম্ভ্রম বিসর্জন দেয় না। ছেঁড়া বোরকা হতে পারে, রং জ্বলে যাওয়া হিজাব হতে পারে, কিন্তু তা তাদের শালীনতাকে ঢেকে রাখে ইস্পাত কঠিন আবরণে। আমরা অভুক্ত থাকতে রাজি, কিন্তু পরিবারের ইজ্জত নিলামে তুলতে রাজি নই। আধুনিকতা বা প্রগতির নামে বেহায়াপনা আমাদের ঘরে ঢুকতে পারে না।
কারণ, আমরা জানি, দাইয়ুস (যে তার পরিবারের অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয়) জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আমাদের ঘরগুলো ছোট, আসবাবপত্র নড়বড়ে, কিন্তু সেখানে কোরআনের তেলাওয়াত হয়, রাসুলের সিরাত চর্চা হয়। এটাই আমাদের ঐশ্বর্য।
​মাঝে মাঝে মনে হয়, আল্লাহ যদি চাইতেন, তবে সবাইকে ধনী বানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করেন, আর কাউকে না দিয়ে। ধনীদের পরীক্ষা হলো তারা শুকরিয়া আদায় করে কি না এবং গরিবের হক দেয় কি না।
আর আমাদের পরীক্ষা হলো আমরা সবর করি কি না এবং হালাল পথে থাকি কি না। হাদিসে এসেছে,
“গরিবরা ধনীদের ৫০০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
এই একটি হাদিস আমাদের সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। ৫০০ বছর! ভাবা যায়? যখন ধনীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিতে দিতে ঘর্মাক্ত হবে, তখন আমরা হয়তো জান্নাতের বাগিচায় ঘুরে বেড়াব। এই আশাই আমাদের চালিকাশক্তি।
এই দুনিয়ার ৬০-৭০ বছরের জীবনটা সেই অনন্তকালের তুলনায় চোখের পলক ফেলার মতো সময়ও নয়। তাই এই সামান্য সময়ের কষ্টকে আমরা হাসিমুখে বরণ করে নিই।
​তবুও, আমরা মানুষ। আমাদেরও কষ্ট হয়। যখন দেখি মেধা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে আমাদের সন্তান ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারছে না, তখন বুকটা ফেটে যায়।
যখন দেখি যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ঘুষ দিতে না পারার কারণে চাকরিটা হচ্ছে না, তখন হতাশা গ্রাস করতে চায়। তখন আমরা সেজদায় লুটিয়ে পড়ি। আল্লাহর কাছে নালিশ করি। বলি,
“হে আল্লাহ! তুমি তো রাজাধিরাজ। তোমার তো ভাণ্ডারের অভাব নেই। আমাদের এই পরীক্ষা আর কতদিন?”
চোখের পানিতে জায়নামাজ ভিজে যায়। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সেই কান্নার পরেই মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসে। মনে হয়, আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছেন। তিনি হয়তো দুনিয়াতে দেবেন না, কিন্তু এর উত্তম প্রতিদান তিনি জমা রেখেছেন।
অথবা তিনি আমাদের এমন কোনো বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, যা আমরা জানি না। এই তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসাই আমাদের একমাত্র সম্বল।
​আমাদের সমাজে হালাল ও হারামের সংমিশ্রণ এখন এতটাই প্রবল যে, হালালভাবে টিকে থাকাটা জ্বলন্ত কয়লা হাতে রাখার মতো। কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি পদে পদে অফার আসে—
“একটু সই করে দিন, মোটা অংক পাবেন।”
“একটু চোখ বন্ধ রাখুন, প্রমোশন হবে।”
এই প্রলোভনগুলো সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের গাইরত বা আত্মসম্মানবোধ সেখানে বাঁধ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা ভাবি, যে হাতে আজ হারাম টাকা নেব, কাল হাশরের ময়দানে সেই হাতই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। আমার চামড়া, আমার চোখ, আমার কান—সবাই সেদিন কথা বলবে। তখন আমি কোথায় পালাব?
এই জবাবদিহিতার ভয় আমাদের অসৎ হতে দেয় না। আমরা বোকা হতে পারি, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা ‘ব্যাকডেটেড’ মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমরা আখেরাত হারানো দেউলিয়া হতে চাই না।
​আমরা যারা নিম্নবিত্ত, আমাদের জীবনটা কোনো উপন্যাসের পাতা নয়, এটা নির্মম বাস্তব। কিন্তু এই বাস্তবের মাঝেও আমরা এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। আমাদের জগৎটা বিশ্বাসের, আমাদের জগৎটা ভালোবাসার। আমরা অল্পতে খুশি হই, অল্পতে হাসি। এক বেলা ভালো খাবার জুটলে আমরা আল্লাহর শুকরিয়ায় নত হই। আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।
কারণ, আমরা জানি, আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদেরই বেশি কষ্টে রাখেন, যাতে তারা তাকে ভুলে না যায়। আমাদের এই অভাব আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি রাখে। এটাই আমাদের বড় পাওয়া।
​আমরা গাইরত ধরে রেখেছি, কারণ আমরা জানি, ইজ্জত আল্লাহর দান। টাকা দিয়ে ইজ্জত কেনা যায় না। অনেক কোটিপতি আছে, যাদের মানুষ ঘৃণা করে। আবার অনেক রিকশাচালক আছে, যাদের মানুষ সালাম দেয়, সম্মান করে তাদের সততার জন্য। আমরা সেই সম্মানের কাঙ্গাল।
আমরা চাই, আমাদের মৃত্যুর পর মানুষ বলুক,
“লোকটা গরিব ছিল, কিন্তু সৎ ছিল।”
এটুকুই আমাদের দুনিয়ার অর্জন। আর আখেরাতের অর্জন তো আল্লাহর জিম্মায়। ​সুতরাং, হে আমার নিম্নবিত্ত ভাই ও বোনেরা! আপনারা যারা সততার সাথে, কষ্টের সাথে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, আপনারা হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না। আপনারা সমাজের বোঝা নন, আপনারা সমাজের বিবেক।
আপনারা আছেন বলেই এখনো আসমান থেকে গজব নাজিল হয় না। আপনাদের চোখের পানির অনেক দাম আল্লাহর কাছে। আপনারা আপনাদের ঈমান ও গাইরতকে আঁকড়ে ধরে রাখুন। এই অন্ধকার রাত কেটে যাবেই। ভোরের আলো আসবেই। সেই ভোর হয়তো দুনিয়াতে আসবে না, কিন্তু মৃত্যুর ঠিক ওপারেই এক সোনালী ভোর আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে কোনো অভাব নেই, কোনো ক্ষুধা নেই, কোনো অপমান নেই। সেখানে শুধু শান্তি আর শান্তি।
​আমাদের এই জীর্ণ কুঁড়েঘর একদিন জান্নাতের প্রাসাদে রূপান্তরিত হবে ইনশাআল্লাহ। আমাদের এই তালি দেওয়া জামা একদিন রেশমি পোশাকে বদলে যাবে। আমাদের এই ক্ষুধার্ত পেট সেদিন জান্নাতি খাবারে তৃপ্ত হবে। শুধু সেই দিনটির অপেক্ষায় আমরা আছি।
ততক্ষণ পর্যন্ত, আসুন আমরা আমাদের গাইরত, আমাদের হালাল-হারামের বোধ এবং আমাদের ঈমানকে বুকের ভেতর আগলে রাখি। দুনিয়া যা খুশি ভাবুক, আমরা তো জানি— আমরা আল্লাহর দলের লোক। আর আল্লাহর দলই চূড়ান্ত বিজয়ী। এই বিশ্বাসই আমাদের বাঁচিয়ে রাখুক, আমৃত্যু।
[যে ঈমান অভাবকে করে ঐশ্বর্যময়]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
image
Send as a message
Share on my page
Share in the group
Translation is not possible.
একটু ভাবুন তো, এই মুহূর্তে আপনি যে শ্বাসটি নিচ্ছেন, বুকের পাঁজরের ভেতর যে হৃৎপিণ্ডটি লাব-ডাব ছন্দে বিরামহীন রক্ত পাম্প করে যাচ্ছে, সেটি কার হুকুমে চলছে?
আপনি হয়তো বলবেন, এটা তো বায়োলজিক্যাল প্রসেস, বিজ্ঞান। কিন্তু এই নিখুঁত বিজ্ঞানের পেছনের কারিগরটি কে?
আপনি যখন আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করছেন, কিংবা যে ব্যক্তি স্রষ্টাকে নিয়ে নোংরা উপহাস করছে তার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন, তখন ঠিক সেই মুহূর্তটিতে আপনার মস্তিষ্কের নিউরনগুলোতে যে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে, তা কার দেওয়া শক্তি?
বড় অদ্ভুত এই মানুষ! যার দেওয়া জিহ্বা নাড়াচাড়া করে শব্দ তৈরি করছেন, সেই জিহ্বা দিয়েই তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন, তাঁকে অপমান করছেন। অথচ তিনি চাইলে ঠিক সেই মুহূর্তেই আপনার বাকশক্তি হরণ করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন না। তিনি ছাড় দেন। আর এই ছাড় দেওয়াকে মানুষ নিজের বিজয় মনে করে। কি ভয়ানক বিভ্রান্তি!
​আপনি কার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন? কার পক্ষে সাফাই গাইছেন?
একটু জানালার পাশে গিয়ে আকাশের দিকে তাকান। এই বিশাল আকাশ, এই নক্ষত্ররাজি, এই মহাজাগতিক শূন্যতা—সবই তো তাঁর। আপনি যে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন, সেই মাটি তো তাঁরই সৃষ্টি। অভিকর্ষ বল দিয়ে তিনি আপনাকে পৃথিবীর বুকে আটকে রেখেছেন। তিনি যদি মুহূর্তের জন্য এই বল সরিয়ে নেন, আপনি মহাশূন্যে ছিটকে পড়বেন।
আবার তিনি যদি অভিকর্ষ একটু বাড়িয়ে দেন, মাটির সাথে মিশে চ্যাপ্টা হয়ে যাবেন। যেই ফ্লোরে দাঁড়িয়ে, যেই কীবোর্ডে আঙ্গুল চালিয়ে আপনি রবের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন, সেই আঙ্গুলের স্নায়ুতন্ত্রের মালিকও তো তিনি।
ভাবুন তো, আপনি কার রাজত্বে বসে কার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন? এ তো এমন এক নিমকহারামি, যার কোনো তুলনা পৃথিবীর অভিধানে নেই। যেন কারও দস্তরখানে বসে পেট ভরে খেয়ে, শেষে সেই দস্তরখানেই থুথু ছিটানো। কিন্তু মনে রাখবেন, থুথু আকাশের দিকে ছিটালে তা নিজের মুখেই এসে পড়ে।
​স্রষ্টাকে নিয়ে যারা ঠাট্টা করে, তাদের পক্ষে যারা যুক্তি খোঁজে, তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছে। তারা মনে করে, আল্লাহ হয়তো তাদের দেখছেন না, কিংবা তাদের এই আস্ফালনে আল্লাহর সম্মান কমে যাচ্ছে। কী হাস্যকর!
এক গ্লাস পানি থেকে এক ফোঁটা পানি তুলে নিলে সাগরের যেমন কিছু আসে যায় না, তেমনি সমগ্র সৃষ্টিজগৎ মিলে আল্লাহকে অস্বীকার করলেও তাঁর প্রতাপে অণু পরিমাণ ঘাটতি হয় না। কিন্তু ক্ষতিটা কার? ক্ষতিটা আপনার।
আপনি যখন সূর্যের দিকে ধুলোবালি ছুঁড়বেন, সূর্য মলিন হবে না, ধুলোবালি আপনার চোখেই এসে পড়বে। আল্লাহ কুরআনে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, "মানুষ কি মনে করে তাকে অনর্থক ছেড়ে দেওয়া হবে?" (সূরা আল-কিয়ামাহ: ৩৬)।
অর্থাৎ, এই যে স্বাধীনতা, এই যে কথা বলার ক্ষমতা, এই যে হাত-পা নাড়ানোর শক্তি—এসব কি এমনি এমনি? কোনো জবাবদিহিতা নেই?
​যারা কটূক্তিকারীর পক্ষ নেন, তারা প্রায়ই 'বাকস্বাধীনতা' বা 'মুক্তচিন্তা'র দোহাই দেন। কিন্তু মুক্তচিন্তা মানে কি সত্যকে অস্বীকার করা? মুক্তচিন্তা মানে কি নিজের শেকড় কেটে ফেলা?
আপনি যখন হাসপাতালে অক্সিজেন মাস্ক পরে শুয়ে থাকেন, তখন এক সিলিন্ডার অক্সিজেনের জন্য হাজার হাজার টাকা গুনতে হয়। আর সারাটা জীবন যিনি আপনাকে বিনে পয়সায় অফুরন্ত অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখলেন, সেই মহান দাতার বিরুদ্ধে কথা বলতে আপনার বিবেকে বাধে না?
উল্টো যারা তাঁকে গালি দেয়, আপনি তাদের বাহবা দেন! এটাকে কি মুক্তচিন্তা বলে, নাকি অকৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত সীমা?
একটু ভেবে দেখুন, আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে কেউ যদি কুরুচিপূর্ণ কথা বলে, আপনি কি তার পক্ষ নেবেন? আপনি কি বলবেন, "আহা, ওর বলার স্বাধীনতা আছে"? নিশ্চয়ই না। আপনার রক্ত গরম হয়ে উঠবে।
অথচ যিনি আপনাকে আপনার বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন, যিনি আপনাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, তাঁকে নিয়ে কটূক্তি করা হলে আপনার রক্ত ঠান্ডা থাকে কী করে? বরং আপনি কটূক্তিকারীর হয়ে তর্কে লিপ্ত হন।
এর মানে হলো, আপনার হৃদয়ের ফিতরাত বা স্বভাবজাত ধর্ম মরে গেছে। ভাইরাসে আক্রান্ত কম্পিউটারের মতো আপনার ভেতরটাও করাপ্টেড হয়ে গেছে।
​আল্লাহ ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না। এই বাক্যটি বড়ই ওজস্বী। কুরআনের ভাষায় একে বলা হয় 'ইস্তিদরাজ' বা ঢিল দেওয়া। আল্লাহ জালিমদের রশি লম্বা করে দেন। তাদের ধন-সম্পদ বাড়ে, খ্যাতি বাড়ে, তাদের অনুসারী বাড়ে। তারা মনে করে, "কই, কিছুই তো হলো না! আমি তো বেশ আছি।" কিন্তু এটাই হলো আল্লাহর সবচেয়ে বড় ফাঁদ। তিনি তাদের পাপের বোঝা পূর্ণ হওয়ার সুযোগ দেন।
আল্লাহ বলেন, "আমি তাদের সময় দিচ্ছি; নিশ্চয়ই আমার কৌশল অত্যন্ত শক্তিশালী।" (সূরা আল-আরাফ: ১৮৩)।
ফেরাউন কি নিজেকে খোদা দাবি করেনি? নমরুদ কি আসমানে তীর ছোঁড়েনি? তাদের পরিণতি কী হয়েছিল? ফেরাউনকে আল্লাহ পানিতে ডুবিয়ে মারলেন, আর নমরুদকে সামান্য এক মশার কাছে পরাজিত করলেন।
ইতিহাস সাক্ষী, যারা আল্লাহর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তারা ধুলোয় মিশে গেছে। তাদের নাম আজ ঘৃণা ভরে স্মরণ করা হয়। আজকের যারা মডার্ন ফেরাউন বা নমরুদ সেজে স্রষ্টাকে অপমান করছে, তাদের পরিণতিও ভিন্ন হবে না। হয়তো আজ তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজারটা লাইক-শেয়ার পাচ্ছে, কিন্তু মহাকালের বিচারে তারা আবর্জনার স্তূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
​যে ব্যক্তি কটূক্তিকারীর পক্ষে কথা বলে, সে নিজেকে ওই অপরাধের অংশীদার বানিয়ে ফেলে। হাদিসে এসেছে, কেউ যদি কোনো পাপ কাজের সমর্থন করে বা তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে, তবে সে-ও সেই পাপের অংশীদার।
ভাবুন তো, কিয়ামতের সেই ভয়াবহ দিনে, যখন সূর্য মাথার খুব কাছে থাকবে, যখন মানুষ 'ইয়া নফসি, ইয়া নফসি' করবে, তখন আপনি কার দলে থাকবেন? সেই কটূক্তিকারীর দলে? সেদিন আল্লাহ যদি আপনাকে প্রশ্ন করেন, "আমার দেওয়া রিজিক খেয়ে, আমার দেওয়া পৃথিবীতে বাস করে, আমারই দুশমনদের সাথে তুমি কেন হাত মিলিয়েছিলে?" তখন কী জবাব দেবেন? তখন কি আপনার সেই তথাকথিত 'লজিক' বা 'ফিলোসফি' কোনো কাজে আসবে?
সেদিন তো মুখে তালা লাগিয়ে দেওয়া হবে। হাত কথা বলবে, পা সাক্ষ্য দেবে। যে হাত দিয়ে আপনি কটূক্তিকারীর সমর্থনে স্ট্যাটাস লিখেছিলেন, সেই হাত আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। যে চোখ দিয়ে আপনি সেই নোংরা লেখাগুলো পড়ে পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছিলেন, সেই চোখ আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। পালাবেন কোথায়? ডানে, বামে, সামনে, পেছনে—সব তো তাঁর রাজত্ব।
​অনেকে বলে, "আল্লাহ তো দয়ালু, তিনি কি এত ছোটখাটো কথায় ধরবেন?" দেখুন, আল্লাহ অবশ্যই পরম দয়ালু (আর-রাহমান), কিন্তু তিনি একই সাথে কঠোর শাস্তিদাতাও (শাদিদ আল-ইক্বাব)। তিনি তাঁর দয়াকে তাদের জন্য রেখেছেন যারা অনুতপ্ত হয়, যারা ফিরে আসে। কিন্তু যারা অহংকার করে, যারা জেনেশুনে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে এবং স্রষ্টার সম্মানহানি করে, তাদের জন্য তাঁর দয়া নয়, বরং তাঁর ন্যায়বিচার অপেক্ষা করছে।
আর আল্লাহর ন্যায়বিচার পাপীদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। আপনি যদি আগুনের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেন এবং আশা করেন আগুন আপনাকে পোড়াবে না কারণ আগুন খুব 'সুন্দর', তবে সেটা আপনার বোকামি। আগুনের ধর্ম পোড়ানো। ঠিক তেমনি, কুফরি এবং আল্লাহকে নিয়ে উপহাসের পরিণতি হলো ধ্বংস। এটা মহাজাগতিক নিয়ম।
​বাস্তবতার দিকে তাকান। একটা সামান্য ভাইরাসের কাছে পুরো পৃথিবী যখন অসহায় হয়ে পড়ে, তখন মানুষের অহংকার কোথায় থাকে? যেই বিজ্ঞান নিয়ে আপনারা বড়াই করেন, সেই বিজ্ঞানও তো আল্লাহর সৃষ্টি করা নিয়ম-নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা নতুন কিছু সৃষ্টি করেন না, তারা কেবল আল্লাহর সৃষ্টি করা বিদ্যমান সূত্রগুলোকে আবিষ্কার করেন মাত্র। নিউটন অভিকর্ষ আবিষ্কার করেছেন, সৃষ্টি করেননি। অভিকর্ষ আগে থেকেই ছিল, কারণ আল্লাহ তা রেখেছিলেন।
তাই বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে স্রষ্টাকে অপমান করাটা হলো নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করা। যে মস্তিষ্ক খাটিয়ে আপনি নাস্তিকতার যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন, সেই মস্তিষ্কের কোটি কোটি কোষের নিয়ন্ত্রণ কি আপনার হাতে? রাতে ঘুমানোর পর আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস কে চালু রাখে? আপনি কি অ্যালার্ম দিয়ে রাখেন যে, "সকাল পর্যন্ত আমার হার্টবিট যেন চলে"? না। এই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে, যাঁকে আপনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন।
​আমাদের সমাজের একটা বড় সমস্যা হলো 'হুজুগেপনা'। একজন আল্লাহকে গালি দিল, আর কিছু মানুষ তাকে 'বুদ্ধিজীবী', 'সাহসী' বা 'বিপ্লবী' তকমা দিয়ে মাথায় তুলে নাচতে শুরু করল। তারা ভাবে, স্রোতের বিপরীতে চলাই বুঝি স্মার্টনেস।
কিন্তু স্রোত যদি হয় সত্যের, আর আপনি যদি হাঁটেন মিথ্যার পথে, তবে সেটা স্মার্টনেস নয়, সেটা হলো আত্মহনন। পয়োনিষ্কাশনের নালায় সাঁতার কেটে নিজেকে সাহসী দাবি করা যায় না, ওটাকে নোংরামো বলে।
আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করা কোনো সাহসিকতা নয়, এটা হলো মানসিক বিকৃতি এবং রুচিহীনতা। আর এই বিকৃত রুচির মানুষদের যারা সমর্থন দেয়, তাদের রুচি নিয়েও প্রশ্ন তোলা উচিত।
​মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। আপনি আস্তিক হোন বা নাস্তিক, মৃত্যুর স্বাদ আপনাকে পেতেই হবে। মৃত্যু যখন শিয়রে এসে দাঁড়াবে, তখন এই পৃথিবী, এই বন্ধু-বান্ধব, এই লাইক-কমেন্ট, এই বাহাদুরি—সব মরীচিকার মতো মিলিয়ে যাবে। সেই মুহূর্তটির কথা ভাবুন। যখন রুহটা শরীর থেকে টেনে বের করা হবে। কবরের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার।
যেখানে কোনো ফিলোজফার বা মোটিভেশনাল স্পিকার আপনাকে বাঁচাতে যাবে না। সেখানে শুধু আপনি আর আপনার আমল। যদি দুনিয়ায় আল্লাহর দুশমনদের বন্ধু বানিয়ে থাকেন, তবে সেই কবরের জীবন হবে বিভীষিকাময়। মাটি চাপ দিয়ে পাঁজরের হাড় এক করে ফেলবে। তখন চিৎকার করে বলবেন, "হে আল্লাহ! আমাকে আরেকবার সুযোগ দাও! আমি বিশ্বাসী হয়ে ফিরে আসব।"
কিন্তু তখন আর কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। কুরআনে আল্লাহ এই দৃশ্যটি আগেই বলে দিয়েছেন, যাতে আমরা সতর্ক হই। সূরা আল-মুমিনুনে তিনি বলেন, "যখন তাদের করো মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব! আমাকে পুনরায় (দুনিয়ায়) প্রেরণ করুন, যাতে আমি আমার ছেড়ে আসা জীবনে সৎকাজ করতে পারি। না, এটা হবার নয়! এটা তো তার একটি কথার কথা মাত্র..."
​আমাদের জীবনটা একটা পরীক্ষার হল। এখানে প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছে (কুরআন), শিক্ষক পাঠানো হয়েছে (রাসূল সা.), এবং সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে (হায়াত)। এখন আপনি যদি পরীক্ষার হলে বসে খাতা ছিঁড়ে ফেলেন, শিক্ষকদের গালি দেন এবং প্রশ্নপত্র নিয়ে মশকরা করেন, তবে পরীক্ষার রেজাল্ট কী হবে তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
আর যে ছাত্রটি এসব করছে, আপনি যদি তার পক্ষ নিয়ে বলেন, "ওর খাতা ছিঁড়ার অধিকার আছে", তবে প্রিন্সিপাল কি আপনাকেই বা ছাড় দেবেন? দুনিয়ার সামান্য স্কুলেই যদি বেয়াদবির শাস্তি টিসি হয়, তবে মহাবিশ্বের মালিকের দরবারে বেয়াদবির শাস্তি কত ভয়াবহ হতে পারে, তা কল্পনারও অতীত।
​আল্লাহর ধৈর্যকে দুর্বলতা ভাববেন না। তিনি নুহা (আ.)-এর জাতিকে সময় দিয়েছিলেন সাড়ে নয়শ বছর। কিন্তু যখন তারা সীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন প্লাবন দিয়ে ধুয়েমুছে সাফ করে দিলেন। লুত (আ.)-এর কওমকে তিনি ছাড় দিয়েছিলেন, কিন্তু যখন তারা পাপাচারের চরম সীমায় পৌঁছাল, জনপদকে উল্টে দিলেন।
আদ ও সামুদ জাতির শক্তিমত্তা আজকের সুপারপাওয়ার দেশগুলোর চেয়েও বেশি ছিল। তারা পাহাড় কেটে বাড়ি বানাত। কিন্তু তাদের পরিণতি কী হয়েছে? আজ তাদের ধ্বংসাবশেষ পর্যটকদের দেখার বিষয় মাত্র। এই ইতিহাসগুলো কি শুধুই গল্প?
না, এগুলো সতর্কবার্তা। আল্লাহ বারবার বলছেন, "তোমরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করো না? তবে দেখ, মিথ্যারোপকারীদের পরিণতি কী হয়েছে?"
​যিনি আপনাকে এক ফোঁটা নাপাক পানি থেকে সৃষ্টি করে আজকের এই সুঠাম দেহের অধিকারী করেছেন, তাঁর প্রতি এই অবজ্ঞা কেন?
আপনার চোখের লেন্স, রেটিনা, কর্নিয়া—কি এক অবিশ্বাস্য ইঞ্জিনিয়ারিং! মানুষের তৈরি ক্যামেরা আজ পর্যন্ত চোখের মতো ডায়নামিক রেঞ্জ বা ফোকাসিং ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এই চোখ দিয়ে আপনি আল্লাহর কুদরত না দেখে, অশ্লীলতা আর কুফরি দেখছেন?
আপনার কানের ভেতরের হাড়গুলো, যা শব্দের কম্পনকে মস্তিষ্কে পৌঁছে দিচ্ছে, তা কি এমনি এমনি হয়েছে? এই নিখুঁত ডিজাইনের পেছনে কি কোনো ডিজাইনার নেই?
একটা সামান্য মোবাইল ফোন যদি আপনা-আপনি তৈরি না হতে পারে, তবে এই অকল্পনীয় জটিল মহাবিশ্ব এবং মানবদেহ কি কোনো স্রষ্টা ছাড়া তৈরি হয়েছে?
এই সহজ সত্যটা যে বোঝে না, সে আসলে অন্ধ। আর যে জেনে-বুঝে অস্বীকার করে, সে হলো অহংকারী। আর অহংকার একমাত্র আল্লাহর চাদর। যে সেই চাদর ধরে টান দেয়, আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।
​যারা কটূক্তিকারীর পক্ষে যায়, তারা মূলত শয়তানের দোসর। শয়তান মানুষকে প্রতিশ্রুতি দেয়, "এটাই আধুনিকতা, এটাই প্রগতি।" কিন্তু শয়তান তো নিজেই অভিশপ্ত। সে চায় বনী আদমকেও তার সাথে জাহান্নামে নিয়ে যেতে। কুরআনে শয়তানের চ্যালেঞ্জের কথা বলা আছে, সে বলেছিল, "আমি তাদের ধোঁকা দেব, তাদের পথভ্রষ্ট করব।" আপনি কি শয়তানের সেই চ্যালেঞ্জ জিতিয়ে দিচ্ছেন না? আপনি কি নিজের অজান্তেই শয়তানের দাবার ঘুঁটি হয়ে যাচ্ছেন না? একটু আত্মোপলব্ধি করুন। ফিরে আসুন নিজের বিবেকের কাছে।
​আল্লাহর দয়া কিন্তু এখনো আপনার জন্য উন্মুক্ত। যতদিন নিঃশ্বাস আছে, ততদিন তওবার দরজা খোলা। যারা অতীতে আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেছে বা কটূক্তিকারীর পক্ষ নিয়েছে, তারা যদি আজই অনুতপ্ত হয়ে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিতে পারেন।
কারণ তিনি 'গফুরুর রাহিম'। তিনি বলেছেন, "হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন।" (সূরা আয-যুমার: ৫৩)। কি
চমৎকার আহ্বান! যেই রবকে আপনি গালি দিলেন, সেই রবই আপনাকে ডাকছেন ক্ষমার চাদর তলে। এমন দয়ালু মালিক আর কোথায় পাবেন? কটূক্তিকারীর পক্ষে গিয়ে আপনি কার কাছে যাবেন? তাদের কি ক্ষমতা আছে আপনাকে মাফ করার? তাদের কি ক্ষমতা আছে আপনার মৃত্যু যন্ত্রণা লাঘব করার? তাদের কি ক্ষমতা আছে কবরের আজাব থেকে আপনাকে বাঁচানোর? নেই। কারো নেই। ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।
​তাই আসুন, স্রোতের বিপরীতে গা ভাসিয়ে নিজের ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস না করি। তথাকথিত 'কুল' বা 'স্মার্ট' হতে গিয়ে ঈমান বিক্রি না করি। মনে রাখবেন, এই পৃথিবীটা একটা ট্রানজিট লাউঞ্জ মাত্র। আসল গন্তব্য সামনে। সেখানে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাবেন নাকি রিমান্ডে যাবেন, তা নির্ভর করছে এই অল্প কয়দিনের আচরণের ওপর।
আল্লাহকে ভালোবাসুন, তাঁকে ভয় করুন। তাঁর সৃষ্টিকে সম্মান করুন। যারা স্রষ্টাকে অপমান করে, তাদের ঘৃণা করুন—ব্যক্তিকে নয়, তাদের কাজকে। তাদের হেদায়েতের জন্য দোয়া করুন, কিন্তু ভুলেও তাদের পাপের সমর্থন করবেন না। কারণ, আগুনের পাশে থাকলে আগুনের আঁচ আপনার গায়েও লাগবে।
​এই আকাশ, এই বাতাস, এই মাটি—সবই সাক্ষ্য দেবে একদিন। যেই মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনি ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, সেই মাটিই সেদিন আপনার বিরুদ্ধে কথা বলবে। যেই চামড়া দিয়ে আপনি পাপ করেছেন, সেই চামড়া আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে। তখন পালানোর কোনো জায়গা থাকবে না। একমাত্র আল্লাহর রহমত ছাড়া সেদিন বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না।
তাই সময় থাকতেই সাবধান হোন। ফিরে আসুন রবের দিকে। সেজদায় লুটিয়ে পড়ুন। বলুন, "হে আমার রব! আমি ভুল করেছি, আমাকে ক্ষমা করো।" বিশ্বাস করুন, এই একটি বাক্যে আপনার জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং দ্বীনের পথে অটল রাখুন। আমিন।
[কার রাজত্বে বিদ্রোহ?]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
image
Send as a message
Share on my page
Share in the group
Translation is not possible.
আপনার কি কখনো গোধূলির আকাশটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়েছে? কিংবা বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে—এই মহাবিশ্বে আমি ধূলিকণার চেয়েও ক্ষুদ্র?
সম্ভবত না। কারণ, আমাদের চোখ এখন আর আকাশ দেখে না, আমাদের চোখ এখন সিসি ক্যামেরার মনিটরে, শেয়ার বাজারের সূচকে, কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাইক আর কমেন্টের ভিড়ে আটকে আছে।
​আমরা এখন পাওয়ার বা ক্ষমতায় বিশ্বাসী। এই যে আপনি, হয়তো কোনো এক বিশাল কর্পোরেট অফিসের ধবধবে সাদা চেয়ারটায় বসে আছেন। গ্লাস ডোরের ওপাশে শত শত মানুষ আপনার হুকুমের অপেক্ষায়। আপনি কলম ঘোরালে কারো ভাগ্য খোলে, কারো কপাল পোড়ে।
কিংবা আপনি হয়তো প্রশাসনের কোনো উচ্চ পদে, অথবা রাজনীতির মাঠে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। আপনার গাড়ির হর্নে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়, আপনার নাম শুনলে মানুষের পিলে চমকে ওঠে।
​এই ক্ষমতা, এই প্রতিপত্তি—এগুলো এক অদ্ভুত নেশা। হেরোইনের চেয়েও মারাত্মক। এই নেশা একবার যাকে পেয়ে বসে, সে আর নিজেকে মানুষ মনে করে না; সে নিজেকে ভাবে 'রব'।
না, সে মুখে হয়তো বলে না "আমি তোমাদের রব", কিন্তু তার আচরণ, তার দম্ভ, আর তার দিগি্বদিগহীন ছুটে চলা বলে দেয়—সে নিজেকে অবিনশ্বর ভাবছে। সে ভাবছে, এই সূর্যটা বোধহয় তার হুকুমে ওঠে, এই বাতাস তার অনুমতি নিয়ে বয়।
​কিন্তু রবকে ভুলে যাওয়ার এই যে আয়োজন, এই যে ক্ষমতার মস্ত বড় প্রদর্শনী—এর শেষটা কোথায়?
​আসুন, একটু ইতিহাসের ধুলোবালি ঘেঁটে দেখি। ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর শিক্ষক, সে কাউকে ক্ষমা করে না। আপনি নমরুদের কথা জানেন। সেই নমরুদ, যার ক্ষমতার দাপটে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খেত। সে কি আজকের দিনের কোনো সাধারণ নেতার মতো ছিল?
মোটেও না। তার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। সে আকাশের দিকে তীর ছুড়েছিল। ভাবুন তো, কতটা স্পর্ধা থাকলে, কতটা মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে একজন মানুষ আকাশের মালিককে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
​নমরুদ ভেবেছিল তার রাজপ্রাসাদ, তার সেনাবাহিনী, তার অঢেল সম্পদ তাকে রক্ষা করবে। সে ইব্রাহিম (আ.)-এর দাওয়াতকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিল। তার যুক্তি ছিল খুব সরল কিন্তু ভয়ংকর—"জীবন ও মৃত্যু তো আমার হাতে। আমি যাকে চাই মারতে পারি, যাকে চাই বাঁচাতে পারি।"
আজকের আধুনিক নমরুদরাও কি একই কথা ভাবছে না?
​আজকের যুগে যারা ক্ষমতার মসনদে বসে আছে, তারা কি ভাবছে না—"এই অর্থনীতির চাকা আমার হাতে, এই মিডিয়া আমার কথায় চলে, এই পারমাণবিক বোমার সুইচ আমার পকেটে। আমিই তো সব!"?
​কিন্তু নমরুদের পতন কীভাবে হয়েছিল? কোনো বিশাল উল্কাপাত তাকে ধ্বংস করেনি। কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী এসে তাকে লেজার দিয়ে ভস্ম করে দেয়নি। তাকে ধ্বংস করেছিল অতি ক্ষুদ্র, তুচ্ছ এক মশা।
হ্যাঁ, একটি মশা। যে মশাটিকে আপনি হাতের আলতো থাপ্পড়ে মেরে ফেলেন, সেই মশাই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাধর স্বৈরাচারকে পাগল বানিয়ে দিয়েছিল। মশাটি তার নাকে ঢুকে মগজে কামড়াত। আর সেই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে নমরুদ তার নিজের মাথায় জুতো দিয়ে আঘাত করার নির্দেশ দিত। ভাবা যায়? যে মাথায় রাজমুকুট ছিল, যে মাথায় অহংকারের আকাশচুম্বী দম্ভ ছিল, সেই মাথায় নিজের খাদেমের জুতোর বাড়ি খেয়ে তাকে মরতে হয়েছে।
​রব এভাবেই শিক্ষা দেন। তিনি দেখান যে, তোমার পারমাণবিক বোমা, তোমার ড্রোন টেকনোলজি, তোমার স্যাটেলাইট নজরদারি—সবই অসার, যদি আমি একটি অদৃশ্য ভাইরাস বা একটি ক্ষুদ্র মশা লেলিয়ে দেই।
​আর ফেরাউন? তার ক্ষমতার ব্যাপ্তি ছিল আরও ভয়ানক। সে তো নিজেকে সরাসরি খোদাই দাবি করে বসেছিল। নীল নদের পানি তার হুকুমে প্রবাহিত হয়—এমনটাই সে বিশ্বাস করাতো তার প্রজাদের। তার ইমান ছিল না, ছিল কেবল ক্ষমতার অন্ধ মোহ। সে মুসা (আ.)-কে জাদুকর ভেবেছিল, সত্যকে ভেবেছিল প্রলাপ।
​ফেরাউন যখন সাগরের বুক চিরে তৈরি হওয়া রাস্তার মাঝখানে, তখনো তার হুঁশ ফিরল না। দুপাশে পানির বিশাল দেয়াল, মাঝখানে সে এবং তার অহংকার। সে ভাবল, "প্রকৃতিও আমাকে ভয় পায়।" কিন্তু যখন পানি আছড়ে পড়ল, যখন নোনা জল তার ফুসফুসে ঢুকতে শুরু করল, তখন সে চিৎকার করে বলেছিল—"আমি মুসার রবের প্রতি ইমান আনলাম।" ​কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তওবার দরজা তখন বন্ধ।
​এখন প্রশ্ন হলো, নমরুদ আর ফেরাউন কি মরে গেছে?
ইতিহাস বলে—হ্যাঁ, তারা মৃত। কিন্তু আধ্যাত্মিক দষ্টিতে তাকালে দেখবেন—না, তারা মরেনি। তাদের শরীর পচে গলে গেছে, মমি হয়ে মিউজিয়ামে পড়ে আছে, কিন্তু তাদের 'আত্মা' বা তাদের 'প্রেতাত্মা' আজও বেঁচে আছে।
​আজকের সমাজে তাকালে আপনি ভূরি ভূরি নমরুদ আর ফেরাউন দেখতে পাবেন। এরা কারা?
​এরা তারাই, যারা ক্ষমতার চেয়ারে বসে ন্যায়-অন্যায় ভুলে যায়। যারা ভাবে, "আমাকে ধরার কেউ নেই।" যারা কলমের খোঁচায় এতিমের সম্পদ গ্রাস করে নেয়। যারা নিরপরাধ মানুষকে জেলের অন্ধকারে পচিয়ে মারে। যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য পুরো একটা জনপদকে ধ্বংস করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
​আপনি কি ভাবছেন নমরুদ শুধু রাষ্ট্র চালায়?
না। আপনার আমার ভেতরেও একটা করে নমরুদ বাস করে। যখন আপনি আপনার অধীনস্থ কর্মচারীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, তখন আপনি নমরুদ। যখন আপনি আপনার স্ত্রীর বা সন্তানের ন্যায্য অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করেন শুধু আপনার পাওয়ার আছে বলে, তখন আপনি ফেরাউনের উত্তরসূরি। যখন আপনি রবের দেওয়া রিজিক খেয়ে রবেরই বিধানকে উপহাস করেন, তখন আপনার আর আবু লাহাবের মধ্যে পার্থক্য থাকে না।
​ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। একে বলা হয় 'ইস্তিদ্রাজ' বা ঢিল দেওয়া। আল্লাহ মাঝে মাঝে জালিমকে দড়ি আলগা করে দেন। তাকে উপরে উঠতে দেন। সে উঠতে থাকে, উঠতে থাকে। সে ভাবে, "আল্লাহ যদি থাকতেন, তাহলে তো আমাকে শাস্তি দিতেন। কই, আমার তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না! আমার ব্যাংক ব্যালেন্স তো বাড়ছেই, আমার শরীর তো সুস্থই আছে।"
​সে জানে না, সে আসলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে না, সে উঠছে এক ভয়ংকর খাদের কিনারায়। যত উপরে সে উঠবে, তার পতনের শব্দ তত বিকট হবে। রব তাকে ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না।
​বাস্তবতার দিকে তাকান। হাসপাতালের আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছেন কখনো? সেখানে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকান। গতকালও হয়তো তিনি ছিলেন কোনো এক বিশাল শিল্পগোষ্ঠীর মালিক। তার এক ইশারায় হাজার হাজার কোটি টাকার ডিল হতো। আর আজ? আজ তার নিজের নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। মেশিনের পাইপ তার নাকে, মুখে। ভেন্টিলেটরের যান্ত্রিক শব্দে তার জীবন ঝুলে আছে।
​কোথায় তার সেই ক্ষমতা? কোথায় তার সেই হুঙ্কার? যে আঙুল উঁচিয়ে তিনি ধমক দিতেন, সেই আঙুলটি নাড়ানোর শক্তিও আজ তার নেই। ডাক্তাররা যখন বলে, "সরি, আমাদের আর কিছু করার নেই"—তখন তার হাজার কোটি টাকা, তার মন্ত্রিত্ব, তার গদি—সবই এক দলা থুতুর চেয়েও মূল্যহীন মনে হয়।
​রবকে ভুলে যাওয়ার মাসুল এভাবেই দিতে হয়। ​আমরা ভুলে যাই যে, আমাদের এই সাজানো জীবনটা আসলে মাকড়সার জালের মতো। বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর জ্যামিতিক নকশা, কিন্তু সামান্য বাতাসের ঝাপটায় তা ছিঁড়ে তছনছ হয়ে যায়।
​একটা ভাইরাসের কথাই ধরুন না। করোনা এসে আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে গেল?
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো, যাদের পারমাণবিক বোমার ভাণ্ডার দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব, তারা একটা আণুবীক্ষণিক জীবাণুর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, তাদের অহংকারী বিজ্ঞান—সবই অসহায় হয়ে পড়ল। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ রাস্তায় কাতরালো। কই, নমরুদের উত্তরসূরিরা তো বাতাস তৈরি করতে পারল না?
​তবুও আমাদের শিক্ষা হয় না। আমরা ভুলে যাই। মানুষের সবচেয়ে বড় রোগ হলো 'বিস্মৃতি'। আমরা রবকে ভুলে যাই, আখেরাতকে ভুলে যাই, কবরের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারকে ভুলে যাই।
​একবার ভাবুন তো কবরের কথা। না, ভৌতিক কোনো গল্পের মতো করে নয়। বাস্তবিক চিন্তা করুন। আজ যে শরীরটাকে আপনি দামী লোশন মাখাচ্ছেন, জিম করে ফিট রাখছেন, যে চেহারার যত্ন নিতে হাজার টাকা খরচ করছেন—সেই শরীরটা মাটির নিচে শুয়ে থাকবে। একা। কোনো এসি নেই, কোনো ফ্যান নেই, কোনো লোশন নেই। আছে শুধু মাটি আর পোকামাকড়।
​আপনার এই ক্ষমতা, এই দাপট কি মাটির পোকাদের থামাতে পারবে? তারা যখন আপনার চোখটা খুবলে খাবে, তখন কি আপনি বলতে পারবেন—"স্টপ! ডু ইউ নো হু আই এম? আমি অমুক কোম্পানির সিইও!"?
​পারবেন না। সেখানে আপনার পরিচয় আপনার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে হবে না। সেখানে আপনার পরিচয় হবে আপনার 'ঈমান' দিয়ে।
​ফেরাউন আজ মিশরের জাদুঘরে শুয়ে আছে। তার শরীরটা অক্ষত রাখা হয়েছে। কেন জানেন? এটা রবের একটা নিদর্শন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, তিনি ফেরাউনের লাশকে সংরক্ষণ করবেন যাতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
​প্রতিদিন হাজার হাজার টুরিস্ট ফেরাউনের মমি দেখতে যায়। তারা তাকে দেখে কী ভাবে? তারা কি তাকে সম্মান করে?
না। তারা তাকে দেখে একটা মৃত, অসহায় বস্তু হিসেবে। কেউ কেউ হয়তো করুণার দৃষ্টিতে তাকায়। ভাবুন তো, যে লোকটা নিজেকে খোদা দাবি করেছিল, আজ সে একটা কাঁচের বাক্সে বন্দি, মানুষের দেখার খোরাক। এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে?
​অথচ, যারা ঈমান এনেছিল, যারা ক্ষমতার দাপটে নত হয়নি, যেমন আসিয়া (আ.)—ফেরাউনের স্ত্রী। তিনি রাজপ্রাসাদের আরাম-আয়েশ লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলেন সত্যের জন্য। ফেরাউন তাকে মরুভূমির তপ্ত বালুতে শুইয়ে বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়ে হত্যা করেছিল। কিন্তু আসিয়া (আ.) কি হেরে গেছেন?
না। আজ হাজার বছর পরেও কোটি কোটি মানুষ আসিয়া (আ.)-এর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। জান্নাতে তার জন্য ঘর তৈরি হয়ে আছে।
​ক্ষমতা আসলে কার? যে জোর করে শরীর দখল করে, তার? নাকি যে আত্মা জয় করে নেয়, তার?
​নমরুদ, ফেরাউনরা শরীর দখল করতে চেয়েছিল, কিন্তু মুসা (আ.) বা ইব্রাহিম (আ.) মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন রবের ভালোবাসা দিয়ে।
​আজকের যুগে আমাদের চারপাশটা বড় বেশি চাকচিক্যময়। কৃত্রিম আলোয় আমরা আসল আলো হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের পকেটে ক্রেডিট কার্ড আছে, কিন্তু হৃদয়ে 'ক্রেডিট' নেই। আমাদের সোশাল মিডিয়ায় হাজার হাজার ফলোয়ার আছে, কিন্তু জানাজার নামাজে দাঁড়ানোর মতো খাঁটি মানুষ নেই।
​আমরা রবকে ভুলে গিয়েছি কারণ আমরা কারণকে কর্তা বানিয়ে ফেলেছি। আমরা মনে করি, "আমি পরিশ্রম করেছি তাই সফল হয়েছি।" "আমার বুদ্ধিতেই এই প্রজেক্টটা পাশ হয়েছে।" অবশ্যই পরিশ্রমের দাম আছে, কিন্তু সেই পরিশ্রম করার শক্তিটা কে দিল? সেই বুদ্ধিটা কার দান?
​মস্তিষ্কের একটা অতি সূক্ষ্ম শিরা যদি ছিঁড়ে যায়, আপনার এই বিশ্বজয়ী বুদ্ধি মুহূর্তে লোপ পাবে। আপনি পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরবেন। এই যে শিরাটা ছিঁড়ছে না, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক আছে—এটা কার দয়া? এটা কি আপনার কৃতিত্ব?
​অথচ এই সুস্থ মস্তিষ্ক দিয়ে আপনি রবের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন। আপনি ভাবছেন, বিজ্ঞানই সব। বিজ্ঞান তো কেবল রবের সৃষ্টির ব্যাখ্যা দেয় মাত্র, বিজ্ঞান তো স্রষ্টা নয়।
​যারা ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছে, তাদের জন্য এই দিনগুলো বড় পরীক্ষার। ক্ষমতা হলো আগুনের মতো। এতে রান্নাও করা যায়, আবার এতে ঘরও পোড়ানো যায়। যার হাতে ক্ষমতা আছে, তার কাঁধে দায়িত্বের বোঝা পাহাড়সমান।
​হযরত উমর (রা.)-এর কথা মনে পড়ে? অর্ধ পৃথিবীর শাসক ছিলেন তিনি। অথচ তিনি রাতে ঘুমাতে পারতেন না। তিনি বলতেন, "ফোরাত নদীর তীরে যদি একটা কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তবে কেয়ামতের দিন উমরকে তার জবাবদিহি করতে হবে।"
​আর আজকের শাসকরা? আজকের ক্ষমতাধররা? তাদের প্রাসাদের পাশেই মানুষ না খেয়ে মরে, ন্যায়বিচার না পেয়ে কাঁদে। আর তারা তখন ব্যস্ত থাকে নিজেদের ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করার ষড়যন্ত্রে। তারা ভুলে যায়, এই দিনই শেষ দিন নয়। বিচারক একজন আছেন, যার এজলাসে কোনো উকিল নেই, কোনো মিথ্যা সাক্ষ্য নেই, কোনো ঘুষ চলে না।
​সেখানে ফেরাউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। নমরুদ তার রাজত্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আর আপনি? আপনি আপনার পদ-পদবি, আপনার পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। সেখানে কথা বলবে আপনার হাত, আপনার পা, আপনার চামড়া।
​আমরা বড় আজব এক সময়ে বাস করছি। এখানে পাপকে বলা হয় 'স্মার্টনেস', আর ঈমানকে বলা হয় 'ব্যাকডেটেড'। এখানে সুদ খাওয়াকে বলা হয় 'বিজনেস স্ট্র্যাটেজি', আর পর্দা করাকে বলা হয় 'রক্ষণশীলতা'। এই উল্টো স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা ভাবছি আমরা খুব প্রগতিশীল।
​আসলে আমরা প্রগতিশীল নই, আমরা 'পতনশীল'। আমরা সেই খাদের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি, যে খাদে নমরুদ আর ফেরাউন তলিয়ে গিয়েছিল।
​ক্ষমতার এই দিনে রবকে ভুলে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কারণ শয়তান আমাদের সামনে এই মরিচিকাটাকে খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করে। সে বলে, "উপভোগ করো। এই তো সময়। জীবন একটাই।"
​হ্যাঁ, জীবন একটাই। আর তাই এই এক জীবনকে জুয়ার টেবিলে বাজি ধরাটা কি বোকামি নয়? অনন্তকালের জীবনের বিনিময়ে এই ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতার স্বাদ নেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?
​একবার ভাবুন, আজ থেকে ১০০ বছর পর আপনার এই ক্ষমতা, এই দাপট, এই নামডাক—কোথায় থাকবে? আপনার কবরের নামফলকটাও হয়তো মুছে যাবে। আপনার হাড়গোড় মাটির সাথে মিশে যাবে। পৃথিবীর মানুষ আপনাকে মনে রাখবে না। ঠিক যেমন আপনি আপনার দাদার বাবার নাম মনে রাখেননি।
​কিন্তু একজন মনে রাখবেন। তিনি রব। তিনি ভুলেন না। তিনি সব লিখে রাখছেন। আপনার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, আপনার মনের প্রতিটি গোপন অহংকার, ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতিটি মুহূর্ত—সব রেকর্ড হচ্ছে।
[ক্ষমতার মরীচিকা ও বিস্মৃত নফসের আহাজারি
(১ম পর্ব)]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Send as a message
Share on my page
Share in the group
Translation is not possible.
এই নিঃস্বতা এমন এক অবস্থা, যেখানে মানুষের হাত ভরে ওঠে প্রাচুর্যে, কিন্তু হৃদয় থাকে শুষ্ক মরুভূমির মতো। বাহ্যিক সফলতা আকাশচুম্বী হলেও, আত্মা থাকে চির-অতৃপ্ত, ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত। এটি এমন এক নিঃস্বতা, যা জগতের কোনো ব্যাংক বা সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না।
আত্মার নিঃস্বতা: ​জীবনের সমস্ত নিয়ামত ও বরকতের মূল কেন্দ্র হলো ক্বলব বা হৃদয়। যখন এই কেন্দ্রটি তার স্রষ্টার সঙ্গে সংযোগ হারায়, তখন জীবনের সমস্ত আলো ম্লান হয়ে যায়।
আত্মার নিঃস্বতা হলো সেই পরিস্থিতি, যখন হৃদয়ের আয়না গুনাহর কালিমায় এতোটাই ঢেকে যায় যে, তাতে আর সত্যের আলো প্রতিফলিত হয় না। ​এই নিঃস্বতার প্রধান লক্ষণ হলো—ইবাদতে স্বাদের অনুপস্থিতি।
​মানুষ নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, কিন্তু তার মন তাতে তৃপ্তি পায় না। এটি ঠিক যেন সুস্বাদু খাবার সামনে থাকার পরও জিভে কোনো স্বাদ না পাওয়া। সে বুঝতে পারে, তার আমলগুলো কেবল কিছু শারীরিক অনুশীলনে পরিণত হয়েছে, যেখানে আত্মার কোনো অংশগ্রহণ নেই। এই স্বাদহীনতা হলো প্রথম সংকেত যে—জীবনের মূল নিয়ামতটি হারিয়ে গেছে।
আন্তঃসম্পর্কিত কারণসমূহ: ​আত্মার এই নিঃস্বতা রাতারাতি আসেনি; এটি আমাদের অসচেতন জীবনযাপনের ফসল। এটি একটি চক্র, যেখানে এক দুর্বলতা অন্য দুর্বলতাকে আকর্ষণ করে:
• ​শুরুর দুর্বলতা: যখন মানুষ সামাজিক মাধ্যমে বা ব্যক্তিগত জীবনে হায়া (লজ্জা ও শালীনতা) নামক অভ্যন্তরীণ ঢালটি সরিয়ে দেয়, তখন তার গোপনীয়তা ও পবিত্রতা নষ্ট হয়। সে সহজেই অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের নেশায় ডুবে যায়।
• ​প্রথম পতন: হায়া দুর্বল হওয়ায় গুনাহ করা সহজ হয়ে যায়। যখন মানুষ সেই গুনাহর উপর অটল থাকে এবং তাওবাহ না করে, তখন একে একে তার জীবন থেকে বরকত ও কল্যাণের নিয়ামত সরে যায় (যেমন—সময়ের বরকত, সুস্থতার বরকত)।
• ​দ্বিতীয় পতন: তাওয়াক্কুলের অভাব জীবনের বরকত চলে যাওয়ায় তার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় না। ফলস্বরূপ, সে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করতে শুরু করে। স্রষ্টার ফয়সালার উপর তার আস্থা কমে যায়। হৃদয়ের স্বাধীনতা (তাওয়াক্কুল) হারিয়ে সে দুশ্চিন্তার দাস হয়ে পড়ে।
• ​চূড়ান্ত পতন: তাওয়াক্কুল না থাকায় সে সবসময় নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে এবং আরও বেশি কিছুর জন্য ছুটতে থাকে। এই অতিরিক্ত প্রত্যাশার ভারে তার হাতে যা আছে, তার প্রতি সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। হৃদয়ের শান্তি (কানা'আত) চিরতরে বিদায় নেয়।
​এই চক্রে পড়ে মানুষ ক্রমাগত ছুটতে থাকে, কিন্তু তার অন্তরের শূন্যতা কেবল বাড়তেই থাকে। সে বাহ্যিকভাবে যত বেশি অর্জন করে, অভ্যন্তরীণভাবে তত বেশি নিঃস্ব হতে থাকে।
​​আধুনিক সমাজের মানুষ কেন এতো হতাশাগ্রস্ত, কেন এতো দ্রুত মেজাজ হারায়—এর কারণ নিহিত এই আত্মার নিঃস্বতায়। নিঃস্ব আত্মার কিছু স্পষ্ট লক্ষণ আছে, যা আমরা আমাদের চারপাশেই দেখতে পাই:
​• অবিরাম অস্থিরতা: সময়ের বরকত না থাকায় মানুষ সর্বদা তাড়াহুড়ো করে। তার কোনো কাজে মন বসে না, তার জীবনে কোনো স্থিরতা নেই। সে দ্রুত এক কাজ থেকে অন্য কাজে যেতে চায়, কিন্তু কোনো কাজই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পারে না।
• সম্পর্কগত অগভীরতা: আত্মার নিঃস্বতা মানুষকে অন্য মানুষের সঙ্গে আন্তরিক সংযোগ স্থাপন করতে দেয় না। সম্পর্কগুলো হয়ে যায় স্বার্থের বা প্রয়োজনের ভিত্তিতে। সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে তা ভেঙে যায়, কারণ হৃদয়ে 'রহম' (দয়া) ও 'মহব্বত' (ভালোবাসা) নামক নিয়ামতগুলো আর অবশিষ্ট নেই।
• মানসিক ভারাক্রান্ততা: সামান্য ব্যর্থতা বা সমালোচনাতেই সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। দুশ্চিন্তা তাকে ঘুমাতে দেয় না। তার মন সব সময় ভয় ও আশঙ্কায় আচ্ছন্ন থাকে। সে পৃথিবীতে সবথেকে নিরাপদ স্থানে থেকেও নিজেকে অনিরাপদ মনে করে।
• লোভ ও কার্পণ্য: সন্তুষ্টি বা কানা'আত না থাকায় তার লোভ বাড়ে। সে আরও সম্পদ জমা করতে চায়, কিন্তু সেই সম্পদ অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা বা বরকত তার থাকে না।
​এই মানুষটি আসলে জগতের সবথেকে অসহায় মানুষ—কারণ তার সমস্যা বাইরে নয়, তার ভেতরে। তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অর্থ নয়, প্রয়োজন আত্মিক পরিশুদ্ধি।
• ​প্রতারণার মরীচিকা: বাইরের আলো ও ভেতরের অন্ধকার
​আধুনিক জীবন আমাদের একটি ভয়াবহ মরীচিকার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমরা ধরে নিয়েছি, যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি হাসে, সবচেয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে বা সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়ায়, সে-ই সুখী।
​কিন্তু আত্মার নিঃস্বতার নির্মমতা হলো—এই বাহ্যিক চাকচিক্য কেবল ভেতরের শূন্যতাকে ঢেকে রাখে।
​একজন মানুষ হয়তো বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বাস করছে, কিন্তু তার ঘরে শান্তি নেই। সে দামি পোশাক পরে নিজেকে সাজাচ্ছে, কিন্তু তার হৃদয় নগ্ন। সে শত মানুষের ভিড়েও নিজেকে একা অনুভব করছে। এটি হলো সেই আত্মার নিঃস্বতা, যা মানুষকে জীবনের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে এক আত্মঘাতী পথে চালিত করে। কারণ সে তার সমস্ত জীবন ব্যয় করেছে এমন সম্পদ অর্জনে, যা হৃদয়ের ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম।
অভ্যন্তরীণ প্রাচুর্যের পথে ফেরা: ​আত্মার নিঃস্বতা থেকে মুক্তি লাভের পথটি কেবল একটিই—স্রষ্টার দিকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসা এবং পূর্বে হারানো নিয়ামতগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা। এটি কোনো একক কাজ নয়, বরং একটি সমন্বিত আধ্যাত্মিক চিকিৎসা।
​• তাওবার অস্ত্রোপচার: সর্বপ্রথম প্রয়োজন গুনাহের পথ থেকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসা। তাওবাহ হলো হৃদয়ের প্রথম অস্ত্রোপচার। এটি সমস্ত গুনাহর কালিমা মুছে ফেলে, যা বরকতের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। যখন গুনাহ বন্ধ হয়, তখন নিয়ামত হারানোর প্রক্রিয়া থেমে যায় এবং স্রষ্টার রহমত নতুন করে জীবনে প্রবেশ করতে শুরু করে।
• যিকির ও ইখলাসের খাদ্য: হৃদয়ের শক্তি ও পবিত্রতা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন স্রষ্টার নিরন্তর স্মরণ বা যিকির। এই যিকির হৃদয়ের মরিচা দূর করে। একই সঙ্গে, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি আমল—তা লোক দেখানো হোক বা একান্ত গোপনে—কেবল স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য করা (ইখলাস)। এটি আমাদের হায়া ও পবিত্রতাকে পুনরুদ্ধার করে।
• তাওয়াক্কুল ও কানা'আতের ঢাল: জীবনের দুশ্চিন্তা থেকে স্থায়ী মুক্তি পেতে তাওয়াক্কুলকে অভ্যাস করুন। মনে রাখুন—রিযিক স্রষ্টার হাতে, আর আপনার কাজ হলো চেষ্টা করা। এই নির্ভরতা আপনার মনকে বর্তমানের প্রতি সন্তুষ্ট (কানা'আত) করে তুলবে। অন্যের জীবনের দিকে তাকানো বন্ধ করুন এবং আপনার যা আছে, তাতে স্রষ্টার কল্যাণ খুঁজুন। এই ঢাল আপনাকে অতিরিক্ত প্রত্যাশার ভার থেকে মুক্ত রাখবে।
• গোপনীয়তার অনুশীলন: ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার জীবনের কিছু সফলতা এবং ইবাদতের কিছু অংশ গোপন রাখুন। এটি আপনার আত্মিক পবিত্রতা বাড়াবে এবং হায়ার নিয়ামতকে দৃঢ় করবে। এটি আপনাকে মানুষের প্রশংসা নামক ক্ষণস্থায়ী মাদক থেকে বাঁচিয়ে দেবে।
​পাঠক, আত্মার নিঃস্বতা হলো আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। হয় আমরা পৃথিবীর পেছনে ছুটতে ছুটতে অভ্যন্তরীণভাবে নিঃস্ব হয়ে যাব, নয়তো আমরা অভ্যন্তরীণ প্রাচুর্যের সন্ধান করে পৃথিবীর সমস্ত ভার থেকে নিজেদের মুক্ত করব।
​স্মরণ রাখবেন, যে ব্যক্তি হৃদয়ে তাওয়াক্কুল ও কানা'আত ধারণ করে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। কারণ তার কোনো ভয় নেই, কোনো অপ্রাপ্তি নেই। আর যে ব্যক্তি হৃদয়ের এই নিয়ামতগুলো হারিয়েছে, সে পৃথিবীর সব সম্পদের মালিক হয়েও সবচেয়ে নিঃস্ব ও অসহায়।
​আসুন, আমরা বাহ্যিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ সচ্ছলতার পথে হাঁটি। কারণ জীবনের আসল সফলতা হাতে নয়, অন্তরে।
এই ৪ পর্বের গভীর আলোচনা এখানেই সমাপ্ত হলো। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
[আধুনিক জীবনে আত্মার নিঃস্বতা (৪র্থ এবং শেষ পর্ব)]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
image
Send as a message
Share on my page
Share in the group
Translation is not possible.
আজকের আধুনিক জীবনে 'দুশ্চিন্তা' এক মহামারী। মানুষ বাহ্যিকভাবে সুস্থ ও সফল হলেও তার অন্তর ক্রমাগত এক ভারে পিষ্ট। এই ভার হলো—অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, যা ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করার এক ব্যর্থ চেষ্টা থেকে জন্ম নেয়। এই চেষ্টা কেবল বৃথা নয়, এটি স্রষ্টার ফয়সালার প্রতি এক নীরব অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। আর এই অসন্তোষই তাওয়াক্কুল নামক পবিত্র নিয়ামতটিকে জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
​দুশ্চিন্তা: (বর্তমান মুহূর্তের উপর ধার্যকৃত কর) ​দুশ্চিন্তা হলো এক অদৃশ্য কর, যা আমরা আমাদের বর্তমান মুহূর্তের সুখ ও শান্তির উপর ধার্য করি এমন কিছুর জন্য, যা এখনও ঘটেনি বা যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই দুশ্চিন্তার উৎস দুটি:
​• অতীতের কৃতকর্মের ভয়: যা করে ফেলেছি, তার ফল কী হবে—এই ভয়।
• ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কা: আগামীতে কী ঘটবে—এই আশঙ্কা।
​অথচ একজন মুমিনের জীবনের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত—বর্তমান মুহূর্তের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং ভবিষ্যতের ভার মহান স্রষ্টার হাতে সঁপে দেওয়া। যখন বান্দা এই ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তখন সে স্রষ্টার নির্ধারিত ফয়সালার উপর নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়, যা এক গভীরতর আত্মিক গুনাহ।
​তাওয়াক্কুলের ভুল ধারণা: (অলসতা নয়, হৃদয়ের আত্মসমর্পণ) ​তাওয়াক্কুল বা স্রষ্টার উপর নির্ভরতা এমন এক নিয়ামত, যা নিয়ে প্রায়শই ভুল ধারণা পোষণ করা হয়। অনেকে মনে করে, তাওয়াক্কুল মানে হাত গুটিয়ে বসে থাকা এবং ভাগ্যের উপর সব ছেড়ে দেওয়া। এটি অলসতা, তাওয়াক্কুল নয়।
​তাওয়াক্কুল দুটি অপরিহার্য ধাপের সমন্বয়ে গঠিত:
• আসবাব গ্রহণ: এটি হলো শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম। আমাদের সাধ্যের মধ্যে যা কিছু করা সম্ভব, তার সবটুকু চেষ্টা করা। একজন কৃষক যেমন জমিতে বীজ বপন না করে ফলনের আশা করতে পারে না, তেমনি আমরাও চেষ্টা না করে সফলতার আশা করতে পারি না।
​• অন্তরের অর্পণ: চেষ্টা করার পর ফলাফল কী হবে, সেই ভার হৃদয়ের গভীর থেকে সম্পূর্ণরূপে স্রষ্টার হাতে সঁপে দেওয়া। এই ধাপেই আসে প্রকৃত তাওয়াক্কুল। অর্থাৎ, আমি আমার করণীয়টুকু সম্পন্ন করলাম, কিন্তু ফলাফল আমার হাতে নয়।
​যখন একজন মানুষ এই দুই ধাপকে বিভক্ত করে ফেলে—হয় সে কেবল চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, অথবা সে অলসতা করে—তখনই সে তাওয়াক্কুলের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়। তাওয়াক্কুল হলো চেষ্টা করার পরও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা, এই বিশ্বাসে যে—স্রষ্টা তার বান্দার জন্য যা ফয়সালা করবেন, তা-ই সর্বোত্তম।
​তাওয়াক্কুলের অফুরান নিয়ামতসমূহ: ​যে হৃদয়ে তাওয়াক্কুল নামক নিয়ামতটি সুরক্ষিত থাকে, সেই হৃদয় পৃথিবীর সমস্ত ভয় ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকে। এই নিয়ামতের কিছু অপরিহার্য ফল নিম্নরূপ:
• প্রশান্তির দুর্ভেদ্য প্রাচীর: তাওয়াক্কুল হলো হৃদয়ের সেই দুর্গ, যেখানে কোনো দুশ্চিন্তা প্রবেশ করতে পারে না। যে জানে—তার রিজিকদাতা একজন, এবং তিনি কখনও ভুল করেন না, সে কেন দুশ্চিন্তা করবে? এই প্রশান্তি পার্থিব সম্পদের চেয়েও মূল্যবান, যা কেবল স্রষ্টার কাছেই পাওয়া যায়।
​• রিযিকের বরকত: তাওয়াক্কুল কেবল রিযিক বা জীবিকা এনে দেয় না, রিযিকে বরকতও এনে দেয়। যখন বান্দা কেবল বৈধ উপায়ে চেষ্টা করে এবং ফলাফলের জন্য স্রষ্টার উপর নির্ভর করে, তখন তার অল্প উপার্জনও তাকে মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট মনে হয় (কানা'আতের সঙ্গে সংযোগ)। আর যে ব্যক্তি দুশ্চিন্তা করে হারামের দিকে ধাবিত হয়, তার প্রচুর উপার্জনও তার জন্য যথেষ্ট হয় না।
• অসাধ্য সাধনের শক্তি: তাওয়াক্কুল মানুষকে অসম্ভবকে জয় করার সাহস দেয়। যখন মানুষ জানে—সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে এবং বাকিটা স্রষ্টার হাতে, তখন সে এমন সব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে, যা সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তার ভয়ে এড়িয়ে চলে। এটি হলো মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি।
​• ফয়সালা গ্রহণের ক্ষমতা: দুশ্চিন্তা মানুষকে সিদ্ধান্তহীন করে দেয়। কিন্তু তাওয়াক্কুল হৃদয়ের স্থিরতা এনে দেয়। যে ব্যক্তি স্রষ্টার উপর নির্ভর করে, সে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কারণ তার মন ফলাফলের ভয় দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে না।
• ​দুশ্চিন্তার ভার: (একটি আত্মিক বিপর্যয়) ​অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা কেবল মানসিক চাপ নয়; এটি হলো স্রষ্টার 'তকদীর' বা ফয়সালার প্রতি এক গভীর অশ্রদ্ধা। যখন আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করি, তখন কার্যত আমরা এই বার্তা দিই যে, "হে স্রষ্টা, আমি মনে করি তুমি পরিস্থিতিকে ততটা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করছ না, যতটা আমি করতে পারি।"
​এই দুশ্চিন্তা আমাদের জীবন থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত ছিনিয়ে নেয়:
​• সুস্থতা ও সময়ের অপচয়: অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা কেড়ে নেয়। এটি হলো সময়ের সবচেয়ে বড় অপচয়, কারণ দুশ্চিন্তা কোনো সমস্যার সমাধান করে না, কেবল সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। যে সময় আমরা ইবাদত, কাজ বা পরিবারের পেছনে ব্যয় করতে পারতাম, সেই সময় কেবল হৃদয়ের ভার বাড়াতে ব্যবহৃত হয়।
• ইবাদতে খুশু-খুযুর অভাব: যে মন দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে, সেই মন নামাজে বা প্রার্থনায় স্থির হতে পারে না। নামাজের মধ্যেও তার চিন্তা থাকে—আগামীকালের বিল, সন্তানের ভবিষ্যৎ বা ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিয়ে। এভাবে তার ইবাদতের স্বাদ এবং খুশু-খুযু নামক নিয়ামতটি সরে যায়। স্রষ্টার সঙ্গে তার সংযোগের তারটি দুর্বল হয়ে পড়ে।
• কৃতজ্ঞতার অভাব: দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন কখনো কৃতজ্ঞ হতে পারে না। কারণ সে সর্বদা ভয় পায় যে, তার হাতে যা আছে, তা হয়তো সে হারিয়ে ফেলবে। সে বর্তমানের নিয়ামতকে উপভোগ না করে কেবল ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। এই ক্রমাগত অকৃতজ্ঞতা তার জীবন থেকে আনন্দের নিয়ামতকে ছিনিয়ে নেয়।
​বাস্তবতার দর্পণে দুশ্চিন্তার চিত্র: (​আজকের সমাজে এই দুশ্চিন্তার ভারের অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান)
• ​শিক্ষিত যুবকের দ্বিধা: একজন যুবক সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছে, কিন্তু সে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করে যে তার ভবিষ্যৎ কী হবে। সে ভুলে যায় যে, তার চেষ্টা ও মেধা ছিল তার সাধ্য, আর রিযিকের ফয়সালা স্রষ্টার হাতে। তার দুশ্চিন্তা তার বর্তমান কাজের গুণগত মান কমিয়ে দেয়।
• ​অভিভাবকের ব্যর্থতা: অনেক অভিভাবক আছেন, যারা সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে এবং সঠিক পরিবেশ তৈরি করতে সবকিছু করেছেন, কিন্তু তবুও তাদের রিযিক নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেন। এই দুশ্চিন্তা তাদের পারিবারিক শান্তি নষ্ট করে এবং সন্তানদের মধ্যে এই বার্তা দেয় যে, জীবনে স্রষ্টার চেয়ে সম্পদই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
• ​সম্পর্কের ভয়: অনেক সময় মানুষ সম্পর্ক হারানোর ভয়ে এমন সব কাজ করে, যা তাদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। কারণ, তারা সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিয়ে স্রষ্টার ফয়সালার উপর নির্ভর না করে নিজেদের দুর্বলতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলস্বরূপ, তারা সম্পর্কের মধ্যে তাদের সম্মান এবং নিজস্বতা নামক নিয়ামতটি হারায়।
•​দাসত্ব থেকে মুক্তি: (নির্ভরতার পথে ফেরা ​অতিরিক্ত) দুশ্চিন্তার ভার হলো এক ধরনের দাসত্ব—যা মানুষকে তার নিজের ভয়, নিজের আকাঙ্ক্ষা এবং পৃথিবীর অনিশ্চয়তার দাস বানিয়ে ফেলে। তাওয়াক্কুল হলো এই দাসত্ব থেকে আত্মার স্বাধীনতা।
​এই স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো হৃদয়ে গেঁথে নিতে হবে:
• সীমা জানা: আপনার সাধ্য ও স্রষ্টার ক্ষমতার মধ্যেকার সীমারেখাটি বুঝুন। আপনার সাধ্য হলো চেষ্টা করা, পরিকল্পনা করা এবং কঠোর পরিশ্রম করা। স্রষ্টার ক্ষমতা হলো—ফলাফল নির্ধারণ করা, রিযিক পৌঁছে দেওয়া এবং আপনার জন্য যা মঙ্গল তা ফয়সালা করা। নিজের সীমা অতিক্রম করে ফলাফলের ভার নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
• অতীতে ফিরে তাকানো (ইসহানের স্মরণ): আপনার জীবনে স্রষ্টা এর আগে কতবার অসম্ভব পরিস্থিতি থেকে আপনাকে উদ্ধার করেছেন, তার হিসাব করুন। আপনার অতীতের প্রতিটি সফলতা, প্রতিটি কঠিন পথ থেকে উত্তরণ—সবই স্রষ্টার অনুগ্রহের প্রমাণ। এই প্রমাণগুলো মনে রাখলে ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা কমে যায়।
• দোয়া: তাওয়াক্কুলের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ: দুশ্চিন্তা তখনই জন্ম নেয় যখন আমরা মুখে বলি 'আল্লাহ ভরসা', কিন্তু হৃদয়ে অনুভব করি না। দোয়া হলো তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ প্রকাশ। যখন আপনি আপনার হৃদয়ের সমস্ত ভার স্রষ্টার কাছে সঁপে দেন, তখন আপনার মন হালকা হয়ে যায়। দোয়া কেবল চাওয়ার মাধ্যম নয়, এটি হলো নির্ভরতার অঙ্গীকার।
​তাওয়াক্কুল হলো জীবনের সেই মূল্যবান নিয়ামত, যা একজন মানুষকে নিঃস্ব অবস্থায়ও ধনী করে রাখে এবং সফল অবস্থায়ও বিনয়ী রাখে। এটি আত্মার এমন এক স্থিরতা, যা পার্থিব কোনো কিছুই টলাতে পারে না। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ভার ঝেড়ে ফেলে এই নির্ভরতার পথে ফেরাটাই একজন মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা।
[তাওয়াক্কুলের নিয়ামত (৩য় পর্ব)]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
image
Send as a message
Share on my page
Share in the group