মাঘের শেষ দিকে হুট করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। অসময়ের বৃষ্টি। শীতের মধ্যে এই বৃষ্টি গরিবের জন্য আজাব, আর ধনীর জন্য রোমান্টিসিজম। অফিসের গ্লাস ওয়ালের ওপাশে ঝাপসা শহরটার দিকে তাকিয়ে আছি। নিচে রাস্তায় ছাতা মাথায় মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা। কাদা-পানির ছপছপ শব্দ এখান থেকে শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে। আমার সহকর্মী জাহিদ ভাই গরম কফির মগ হাতে পাশে এসে দাঁড়ালেন।
\"কি ওয়েদার মাইরি! আজ খিচুড়ি আর গরুর মাংস হলে জমত, তাই না?\" জাহিদ ভাই বেশ আয়েশ করে চুমুক দিলেন কফিতে।
আমি তার দিকে তাকালাম। এই মানুষটা খারাপ না। কিন্তু তার জগৎটা শুধুই পেট আর পিঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তার কাছে বৃষ্টির মানে খিচুড়ি, আর শীতের মানে বারবিকিউ পার্টি। আমি মৃদু হেসে বললাম, \"জাহিদ ভাই, এই বৃষ্টিতে ফুটপাতের মানুষগুলোর কথা ভাবছেন? ওদের তো পলিথিন টানানোরও জায়গা নেই।\"
জাহিদ ভাই একটু অপ্রস্তুত হলেন। \"আরে ধুর, তুমি সবসময় এত নেগেটিভ ভাবো কেন? ওদের অভ্যাস আছে। সরকার দেখবে ওদের। তুমি কফি খাবে?\"
\"না ভাই, রোজা আছি।\"
জাহিদ ভাই চোখ বড় বড় করে তাকালেন। \"আজ তো সোমবার না, বৃহস্পতিবারও না। হঠাৎ রোজা?\"
আমি জানালা দিয়ে বাইরের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, \"এমনিই। একটু ক্ষুধার কষ্টটা অনুভব করার চেষ্টা করছি। গাজার মানুষগুলো তো ঘাস খেয়ে রোজা রাখছে, আর আমি সেহেরিতে ভাত খেয়েও তৃপ্তি পাই না। তাই ভাবলাম, নফসটাকে একটু শাসন করি।\"
জাহিদ ভাই চুপ করে গেলেন। তিনি হয়তো আমাকে \'মৌলবাদী\' বা \'আতেল\' ভাবছেন। ভাবুন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সাহাবীরা যখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তখন মক্কার লোকেরা তাদের \'পাগল\' বলত। আজ আমরা যদি সেই পাগলামির ছিটেফোঁটাও অর্জন করতে পারি, তবে সেটাই সফলতা।
লাঞ্চ ব্রেক। আজ আমাদের সেই \'স্টাডি সার্কেলের\' প্রথম বসা। তানভীর কনফারেন্স রুমের একটা কোণা ম্যানেজ করেছে। ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কেউ আসবে কি না। তানভীর, সাকিব আর আমি—আমরা তিনজন তো আছিই। কিন্তু অবাক করে দিয়ে দেখলাম, আরও চারজন কলিগ এসে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে একজন রিফাত। অফিসের সবচেয়ে \'মডার্ন\' ছেলে। কানে ইয়ারপড, হাতে ট্যাটু, আর মুখে সবসময় লেটেস্ট ওয়েব সিরিজ নিয়ে আলোচনা। ও এখানে কেন? মজা নিতে এসেছে?
সবাই গোল হয়ে বসলাম। টেবিলের মাঝখানে কোনো খাবার নেই। শুধু একটা কুরআন শরীফ আর কয়েকটা পানির বোতল। পরিবেশটা বেশ গম্ভীর। তানভীর আমাকে ইশারা করল শুরু করার জন্য। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। আমি তো কোনো বক্তা নই। আমি তো নিজেই একজন পথহারা মুসাফির।
\"বিসমিল্লাহ,\" বলে শুরু করলাম। \"ভাইয়েরা, আমরা এখানে কোনো ওয়াজ মাহফিল করতে বসিনি। আমরা এখানে বসেছি নিজেদের আয়নায় দেখার জন্য। আমরা সবাই মুসলিম, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমাদের ইসলামের দৌড় কতদূর? জুমার নামাজ আর ঈদের কোলাকুলি? নাকি তার চেয়েও গভীরে?\"
রিফাত হঠাৎ হাত তুলল। ওর মুখে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসি। \"ব্রাদার, একটা প্রশ্ন ছিল। এই যে আমরা এখানে বসেছি, গাজা নিয়ে বা ধর্ম নিয়ে কথা বলছি, এতে কি প্র্যাকটিক্যালি কোনো লাভ হবে? মানে, আমাদের জিডিপি বাড়বে? নাকি ইসরায়েল যুদ্ধ থামাবে? আমরা তো ইমোশনাল জাতি, হুজুগে মাতি বেশি। কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছে না।\"
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল। তানভীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি ওকে থামালাম। এই প্রশ্নটা রিফাতের একার না, এটা আমাদের পুরো প্রজন্মের প্রশ্ন। আমরা সবকিছুকে \'লাভ-ক্ষতি\'র দাঁড়িপাল্লায় মাপি।
আমি শান্ত গলায় বললাম, \"রিফাত, তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা ইমোশনাল। কিন্তু ইমোশন ছাড়া মানুষ আর রোবটের মধ্যে তফাৎ কী? আর কাজের কথা বলছ? আচ্ছা, ধরো তোমার মা খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে বাঁচার আশা নেই। তুমি কি তখন ওষুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেবে? তুমি কি বলবে—\'প্র্যাকটিক্যালি তো কোনো লাভ নেই, মা তো মরবেই, শুধু শুধু টাকা খরচ করে কী লাভ?\'\"
রিফাত চুপ করে গেল। ওর হাসিটা মিলিয়ে গেছে।
আমি বলে চললাম, \"তুমি তা করবে না। তুমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করবে। কেন? কারণ ওটা তোমার মা। তোমার অস্তিত্বের শেকড়। গাজা আমাদের মায়ের মতো, রিফাত। উম্মাহ মানে মা। মুসলিম উম্মাহ একটা মায়ের মতো। সেই মায়ের শরীরে যখন পচন ধরে, তখন সন্তান হিসেবে আমরা যদি বলি \'লাভ কী\', তবে আমরা কুলাঙ্গার সন্তান। আমরা এখানে বসেছি ইসরায়েলকে থামানোর জন্য নয়, আমরা এখানে বসেছি আল্লাহর কাছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে—\'হে আল্লাহ, আমাদের হাতে ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু আমাদের দিলে ব্যথা ছিল। আমরা উদাসীন ছিলাম না\'।\"
রিফাত মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি কুরআনের পাতা উল্টালাম। সূরা আত-তওবা, আয়াত ২৪। আয়াতটা পড়ার আগে বললাম, \"আমরা যারা ব্র্যান্ডের পেছনের ঘুরি, ক্যারিয়ার নিয়ে পাগল, তাদের জন্য আল্লাহ একটা অ্যালার্ম দিয়েছেন। শুনবেন?\"
তিলাওয়াত করলাম অর্থসহ:
\"বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় করো এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করো—আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর নির্দেশ (আযাব) আসা পর্যন্ত।\"
পড়তে পড়তে আমার কণ্ঠ ধরে এল। \"ভাইয়েরা, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমাদের কাছে আজ কোনটা প্রিয়? ফজরের নামাজের চেয়ে কি ঘুমের আরাম প্রিয় নয়? আল্লাহর হুকুমের চেয়ে কি বসের হুকুম প্রিয় নয়? আমরা তো সেই জাতি, যারা মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-এর উত্তরসূরি। মুসআব (রা.) মক্কার সবচেয়ে হ্যান্ডসাম যুবক ছিলেন। সবচেয়ে দামী সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। সেই মুসআব যখন ইসলাম কবুল করলেন, মা তাকে ত্যাজ্য করল, সম্পদ কেড়ে নিল। উহুদের যুদ্ধে যখন তিনি শহিদ হলেন, তখন তার কাফনের কাপড় এত ছোট ছিল যে, মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যেত, আর পা ঢাকলে মাথা। রাসুল (সা.) কেঁদে বলেছিলেন—\'মুসআব! আজ তোমার এই অবস্থা! অথচ মক্কায় তোমার মতো বিলাসী কেউ ছিল না।\' কেন তিনি সব ছাড়লেন? কার জন্য?\"
ঘরটা একদম নিস্তব্ধ। শুধু বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে। হঠাৎ দেখলাম সাকিবের চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে গেছে। সে চশমা খুলে চোখ মুছল। রিফাত, সেই উদ্ধত রিফাত, তার হাতের ট্যাটুটা আড়াল করার চেষ্টা করছে জামার হাতা টেনে। হয়তো তার মনে হচ্ছে, এই চামড়াটা আল্লাহর আমানত, আর সে তাতে কী একেছে!
তানভীর বলল, \"আমরা অনেক ভুল করেছি। অনেক সময় নষ্ট করেছি। কিন্তু আর না। আজ থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করব—আমাদের আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ, হোক সেটা ৫ শতাংশ বা ১০ শতাংশ, আমরা মানুষের কল্যাণে দেব। আর আমরা নিজেদের জানব। পড়ব। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন আমরা এই স্টাডি সার্কেল চালু রাখব।\"
সবাই মাথা নাড়ল। রিফাত বলল, \"আমি... আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমার স্যালারির অর্ধেকটা আমি এই মাসে ডোনেট করতে চাই। কিন্তু আমি জানি না কোথায় দিতে হবে। তোমরা কি হেল্প করবে?\"
আমার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! পাথরের বুক চিরেও ঝরনাধারা বের হতে পারে! রিফাত, যাকে আমি ভেবেছিলাম সবচেয়ে বড় বাধা, সে আজ সবচেয়ে বড় ত্যাগের ঘোষণা দিল।
মিটিং শেষ হলো। সবাই যখন বের হচ্ছে, তখন মনে হলো ওদের কাঁধের ভারটা যেন কিছুটা কমে গেছে। অথবা হয়তো ভারটা বেড়েছে—দায়িত্বের ভার। কিন্তু এই ভার বহন করার মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ আছে।
বিকেলে অফিস থেকে বের হলাম। বৃষ্টি থামেনি। গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে। আমার ছাতা নেই। হুডিটা মাথায় টেনে নিলাম। রাস্তায় পানি জমে গেছে। রিকশা পাওয়া দুষ্কর। হাঁটতে শুরু করলাম।
হাঁটতে হাঁটতে পকেটে হাত দিলাম। মোবাইলটা বের করলাম। গাজার আপডেট দেখার সাহস হচ্ছে না। তবুও দেখলাম। জাবালিয়া ক্যাম্পে হামলা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে শত শত মানুষ। একটা ভিডিওতে দেখলাম, বৃষ্টির পানিতে তাঁবু ভেসে গেছে। কাদামাটিতে বসে এক শিশু কাঁদছে। তার গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই।
আমার গায়ের হুডিটা যেন আগুনের মতো গরম মনে হতে লাগল। আমি এই শহরে, এই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে বাড়ি ফিরব, গরম কফি খাব, লেপের নিচে ঘুমাব। আর ওই শিশুটা?
হঠাৎ মনে পড়ল, আমার বাসায় একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা পড়ে আছে। শখ করে কিনেছিলাম ফটোগ্রাফি করব বলে। গত দুই বছরে ওটা আলমারি থেকে বের করা হয়নি। লেন্সসহ ওটার দাম অন্তত ষাট-সত্তর হাজার টাকা হবে। ওটা দিয়ে আমি কী করব? প্রকৃতির ছবি তুলব? মানুষের হাসিমুখের ছবি তুলব? যেখানে আমার উম্মাহর চেহারা রক্তে মাখা, সেখানে আমি ফুলের ছবি তোলার বিলাসিতা করি কী করে?
সিদ্ধান্ত নিলাম। ওটা বেচে দেব। এখনই।
আমি উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করলাম। ইলেকট্রনিক্স মার্কেটের দিকে। বৃষ্টির ঝাপটা মুখে লাগছে। মনে হচ্ছে এই বৃষ্টি আমার গুনাহগুলো ধুয়ে দিচ্ছে। আমি জানি, ক্যামেরা বিক্রির টাকা দিয়ে গাজা স্বাধীন হবে না। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে যদি একটা তেরপল কেনা যায়, একটা কম্বল কেনা যায়, তবে হাশরের ময়দানে আমি ওই ক্যামেরাটা সাক্ষী হিসেবে পাব না, পাব ওই কম্বলটা।
দোকানে গেলাম। পরিচিত এক বড় ভাই আছেন, যিনি সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যামেরা কেনেন। আমাকে দেখে অবাক হলেন। \"কি ভাই, ভিজে একাকার অবস্থা! ক্যামেরা বিক্রি করবেন? নতুন মডেল নেবেন নাকি?\"
আমি ক্যামেরাটা কাউন্টারে রাখলাম। \"না ভাই, নতুন কিছু নেব না। শুধু বিক্রি করব। ইমার্জেন্সি টাকা দরকার।\"
তিনি ক্যামেরাটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। \"কন্ডিশন তো একদম ফ্রেশ। পঁয়তাল্লিশ হাজার দিতে পারব। এর বেশি হবে না ভাই।\"
আমি দরদাম করলাম না। বললাম, \"আলহামদুলিল্লাহ। দিন।\"
টাকাটা হাতে নিয়ে যখন দোকান থেকে বের হলাম, তখন এক অদ্ভুত হালকাবোধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে পিঠের ওপর থেকে বিশাল এক বোঝা নেমে গেল। আমার প্রিয় শখ, আমার প্যাশন—সবকিছু আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করে দেওয়ার যে স্বাদ, তা কোনো বিরিয়ানি বা ব্র্যান্ডের পোশাকে নেই।
বাসায় ফেরার পথে তানভীরকে ফোন দিলাম।
\"দোস্ত, আমার ক্যামেরাটা বেচে দিলাম।\"
তানভীর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, \"আল্লাহ কবুল করুন দোস্ত। আল্লাহ তোর এই ব্যবসার উত্তম প্রতিদান দিন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন।\"
বাসায় ঢুকলাম। মা জায়নামাজে বসে তসবিহ পড়ছিলেন। আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে বললেন, \"কিরে, ছাতা নিসনি? জ্বর আসবে তো।\"
আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। ভেজা মাথাটা মায়ের কোলে রাখলাম। মা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। এই স্পর্শটা কত শান্তির! গাজার কত সন্তান আজ এই স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। কত মা আজ সন্তানের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
\"মা,\" আমি ফিসফিস করে বললাম।
\"বল বাবা।\"
\"আমাদের কি অনেক বেশি দরকার? বাঁচার জন্য?\"
মা হাসলেন। \"না রে পাগল। বাঁচার জন্য তো অল্পই দরকার। আমরা তো বাঁচার জন্য খাই না, খাওয়ার জন্য বাঁচি—তাই এত দরকার হয়।\"
\"মা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার জমানো টাকা আর ক্যামেরা বিক্রির টাকাটা আমি ফিলিস্তিনে পাঠাতে চাই। আমাদের পরিচিত এক এনজিওর ভাই আছেন, যিনি সরাসরি বর্ডারে কাজ করছেন। আমি কি দেব?\"
মা আমার মুখটা তুলে ধরলেন। তার চোখে পানি, কিন্তু ঠোঁটে হাসি। \"তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস? ওটা তো আল্লাহর মাল। তুই তো শুধু আমানতদার। দিয়ে দে বাবা। সব দিয়ে দে। আল্লাহ যদি আমাদের রিজিকে বরকত দেন, তবে ডাল-ভাতেই পেট ভরবে। আর যদি বরকত না থাকে, তবে পোলাও খেয়েও শান্তি পাবি না।\"
মায়ের কথা শুনে আমার ভেতরটা শান্ত হয়ে গেল। মায়েরা আসলে অনেক বড় আলেম। তারা কিতাব না পড়েও ইসলামের নির্যাসটুকু বুঝে ফেলেন।
রাতে ইফতারের সময় (নফল রোজার ইফতার) সামান্য খেজুর আর পানি দিয়ে রোজা ভাঙলাম। রাফিয়া আমার জন্য শরবত বানিয়ে এনেছে। ও ইদানীং খুব চুপচাপ। ওর মোবাইলে এখন আর হিন্দি গানের রিলস বাজে না। ও এখন ফিলিস্তিনের ইতিহাস পড়ছে। গতকাল ও আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, \"ভাইয়া, সালাউদ্দিন আইয়ুবী কি সত্যিই একা জেরুজালেম জয় করেছিলেন?\" আমি বলেছিলাম, \"একা না বোন, তার সাথে ছিল একদল রুহানি সৈনিক, যারা রাতের আঁধারে জায়নামাজ ভেজাত, আর দিনের আলোয় ঘোড়া ছোটাত।\"
রাফিয়া তখন বলেছিল, \"আমিও কি সেই সৈনিক হতে পারি ভাইয়া? আমার তো ঘোড়া নেই, তলোয়ার নেই।\"
আমি বলেছিলাম, \"তোর ঘোড়া নেই, কিন্তু তোর লজ্জা আছে, তোর পর্দা আছে। তোর তলোয়ার নেই, কিন্তু তোর কলম আছে, তোর মেধা আছে। তুই তোর জায়গা থেকে যুদ্ধ কর।\"
রাফিয়া আজ হিজাব পরে আমার সামনে এসেছে। ঠিকমতো বাঁধতে পারেনি, এলোমেলো হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে ওকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রাজকন্যা মনে হচ্ছে। এই তো বিজয়। এই তো বিপ্লব।
রাতের খাবার শেষে আমি আমার ডায়েরিটা খুললাম। একটা কথা মনে পড়লো, \"গল্পগুলো অন্যরকম হতে পারত।\" হ্যাঁ, আমাদের গল্পগুলো অন্যরকম হতে পারত। আমরা শুধুই ভোগবাদী প্রাণী হয়ে মরতে পারতাম। কিন্তু আল্লাহ আমাদের দয়া করেছেন। তিনি আমাদের জাগিয়েছেন।
আমি লিখলাম:
শিরোনাম: একটি ক্যামেরা ও কিছু ছেঁড়া স্বপ্ন
\"আজ আমি আমার শখের লেন্সটা বিক্রি করে দিলাম। লেন্সটা দিয়ে জুম করলে অনেক দূরের জিনিস কাছে দেখা যেত। কিন্তু আজ আমি লেন্স ছাড়াই অনেক দূরের একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি—জান্নাতের দরজায় কিছু ধুলোমাখা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গায়ে দামী জ্যাকেট নেই, তাদের পায়ে ব্র্যান্ডের জুতো নেই। কিন্তু তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও উজ্জ্বল। ফেরেশতারা তাদের স্যালুট দিচ্ছে।
আমি কি সেই লাইনে দাঁড়াতে পারব? আমার আমলনামায় তো শুধুই গাফিলতি। কিন্তু হে আল্লাহ! তুমি তো অন্তর্যামী। তুমি জানো, আজ এই শখের বস্তুটা বিক্রি করার সময় আমার একটুও কষ্ট হয়নি। বরং মনে হয়েছে, আমি একটা জান্নাতের টিকেট বুকিং দিলাম।
শীত এখনো আছে। বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু আমার রুহের ভেতরে এখন বসন্তের বাতাস। কারণ আমি বুঝতে শিখেছি—দেওয়ার নামই সুখ, আঁকড়ে ধরার নাম যন্ত্রণা।\"
লেখা শেষ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে একটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। ওটা কি ধ্রুবতারা? নাকি ওটা গাজার কোনো এক শহিদি আত্মার আলো?
আমি জানি না। তবে এটুকু জানি, আমাদের এই ছোট ছোট ত্যাগগুলো বৃথা যাবে না। বিন্দু বিন্দু জল দিয়েই সিন্ধু হয়। আমরা হয়তো আবাবিল পাখির মতো ছোট, কিন্তু আমাদের পাথরগুলো যদি সঠিক লক্ষ্যে ছুড়তে পারি, তবে আধুনিক নমরুদদের পতন নিশ্চিত।
তানভীর, সাকিব, রিফাত, রাফিয়া, মা—আমরা সবাই এখন একটা অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা। রুহানিয়ার সুতো। এই সুতো ছিঁড়বে না ইনশাআল্লাহ।
বিছানায় যাওয়ার আগে আমি আমার পুরনো জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। কাল ফজরের নামাজে এই জ্যাকেট পরেই যাব। ইমাম সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে যখন \'আমিন\' বলব, তখন যেন আমার আমিন ধ্বনি গাজার ধ্বংসস্তূপ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
\"জেগেছে যুবক, জেগেছে প্রাণ,
শুনছি আবার বিজয়ের গান।
শখের খাঁচা ভেঙেছি আজ,
পরবো না আর মিথ্যে তাজ।
এক আল্লাহ, এক উম্মাহ,
ভয় কি আর? নেই তো ভয়!
রক্তে কেনা এই ঈমান,
আনবে ঠিকই বিশ্বজয়।\"
[রুহানিয়া]
[৫]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
মাঘের শেষ দিকে হুট করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। অসময়ের বৃষ্টি। শীতের মধ্যে এই বৃষ্টি গরিবের জন্য আজাব, আর ধনীর জন্য রোমান্টিসিজম। অফিসের গ্লাস ওয়ালের ওপাশে ঝাপসা শহরটার দিকে তাকিয়ে আছি। নিচে রাস্তায় ছাতা মাথায় মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা। কাদা-পানির ছপছপ শব্দ এখান থেকে শোনা যাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে। আমার সহকর্মী জাহিদ ভাই গরম কফির মগ হাতে পাশে এসে দাঁড়ালেন।
"কি ওয়েদার মাইরি! আজ খিচুড়ি আর গরুর মাংস হলে জমত, তাই না?" জাহিদ ভাই বেশ আয়েশ করে চুমুক দিলেন কফিতে।
আমি তার দিকে তাকালাম। এই মানুষটা খারাপ না। কিন্তু তার জগৎটা শুধুই পেট আর পিঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তার কাছে বৃষ্টির মানে খিচুড়ি, আর শীতের মানে বারবিকিউ পার্টি। আমি মৃদু হেসে বললাম, "জাহিদ ভাই, এই বৃষ্টিতে ফুটপাতের মানুষগুলোর কথা ভাবছেন? ওদের তো পলিথিন টানানোরও জায়গা নেই।"
জাহিদ ভাই একটু অপ্রস্তুত হলেন। "আরে ধুর, তুমি সবসময় এত নেগেটিভ ভাবো কেন? ওদের অভ্যাস আছে। সরকার দেখবে ওদের। তুমি কফি খাবে?"
"না ভাই, রোজা আছি।"
জাহিদ ভাই চোখ বড় বড় করে তাকালেন। "আজ তো সোমবার না, বৃহস্পতিবারও না। হঠাৎ রোজা?"
আমি জানালা দিয়ে বাইরের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, "এমনিই। একটু ক্ষুধার কষ্টটা অনুভব করার চেষ্টা করছি। গাজার মানুষগুলো তো ঘাস খেয়ে রোজা রাখছে, আর আমি সেহেরিতে ভাত খেয়েও তৃপ্তি পাই না। তাই ভাবলাম, নফসটাকে একটু শাসন করি।"
জাহিদ ভাই চুপ করে গেলেন। তিনি হয়তো আমাকে 'মৌলবাদী' বা 'আতেল' ভাবছেন। ভাবুন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সাহাবীরা যখন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তখন মক্কার লোকেরা তাদের 'পাগল' বলত। আজ আমরা যদি সেই পাগলামির ছিটেফোঁটাও অর্জন করতে পারি, তবে সেটাই সফলতা।
লাঞ্চ ব্রেক। আজ আমাদের সেই 'স্টাডি সার্কেলের' প্রথম বসা। তানভীর কনফারেন্স রুমের একটা কোণা ম্যানেজ করেছে। ভয়ে ভয়ে ছিলাম, কেউ আসবে কি না। তানভীর, সাকিব আর আমি—আমরা তিনজন তো আছিই। কিন্তু অবাক করে দিয়ে দেখলাম, আরও চারজন কলিগ এসে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে একজন রিফাত। অফিসের সবচেয়ে 'মডার্ন' ছেলে। কানে ইয়ারপড, হাতে ট্যাটু, আর মুখে সবসময় লেটেস্ট ওয়েব সিরিজ নিয়ে আলোচনা। ও এখানে কেন? মজা নিতে এসেছে?
সবাই গোল হয়ে বসলাম। টেবিলের মাঝখানে কোনো খাবার নেই। শুধু একটা কুরআন শরীফ আর কয়েকটা পানির বোতল। পরিবেশটা বেশ গম্ভীর। তানভীর আমাকে ইশারা করল শুরু করার জন্য। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। আমি তো কোনো বক্তা নই। আমি তো নিজেই একজন পথহারা মুসাফির।
"বিসমিল্লাহ," বলে শুরু করলাম। "ভাইয়েরা, আমরা এখানে কোনো ওয়াজ মাহফিল করতে বসিনি। আমরা এখানে বসেছি নিজেদের আয়নায় দেখার জন্য। আমরা সবাই মুসলিম, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমাদের ইসলামের দৌড় কতদূর? জুমার নামাজ আর ঈদের কোলাকুলি? নাকি তার চেয়েও গভীরে?"
রিফাত হঠাৎ হাত তুলল। ওর মুখে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসি। "ব্রাদার, একটা প্রশ্ন ছিল। এই যে আমরা এখানে বসেছি, গাজা নিয়ে বা ধর্ম নিয়ে কথা বলছি, এতে কি প্র্যাকটিক্যালি কোনো লাভ হবে? মানে, আমাদের জিডিপি বাড়বে? নাকি ইসরায়েল যুদ্ধ থামাবে? আমরা তো ইমোশনাল জাতি, হুজুগে মাতি বেশি। কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছে না।"
ঘরের বাতাস ভারী হয়ে গেল। তানভীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, আমি ওকে থামালাম। এই প্রশ্নটা রিফাতের একার না, এটা আমাদের পুরো প্রজন্মের প্রশ্ন। আমরা সবকিছুকে 'লাভ-ক্ষতি'র দাঁড়িপাল্লায় মাপি।
আমি শান্ত গলায় বললাম, "রিফাত, তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা ইমোশনাল। কিন্তু ইমোশন ছাড়া মানুষ আর রোবটের মধ্যে তফাৎ কী? আর কাজের কথা বলছ? আচ্ছা, ধরো তোমার মা খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে বাঁচার আশা নেই। তুমি কি তখন ওষুধ খাওয়ানো বন্ধ করে দেবে? তুমি কি বলবে—'প্র্যাকটিক্যালি তো কোনো লাভ নেই, মা তো মরবেই, শুধু শুধু টাকা খরচ করে কী লাভ?'"
রিফাত চুপ করে গেল। ওর হাসিটা মিলিয়ে গেছে।
আমি বলে চললাম, "তুমি তা করবে না। তুমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করবে। কেন? কারণ ওটা তোমার মা। তোমার অস্তিত্বের শেকড়। গাজা আমাদের মায়ের মতো, রিফাত। উম্মাহ মানে মা। মুসলিম উম্মাহ একটা মায়ের মতো। সেই মায়ের শরীরে যখন পচন ধরে, তখন সন্তান হিসেবে আমরা যদি বলি 'লাভ কী', তবে আমরা কুলাঙ্গার সন্তান। আমরা এখানে বসেছি ইসরায়েলকে থামানোর জন্য নয়, আমরা এখানে বসেছি আল্লাহর কাছে এটা প্রমাণ করার জন্য যে—'হে আল্লাহ, আমাদের হাতে ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু আমাদের দিলে ব্যথা ছিল। আমরা উদাসীন ছিলাম না'।"
রিফাত মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি কুরআনের পাতা উল্টালাম। সূরা আত-তওবা, আয়াত ২৪। আয়াতটা পড়ার আগে বললাম, "আমরা যারা ব্র্যান্ডের পেছনের ঘুরি, ক্যারিয়ার নিয়ে পাগল, তাদের জন্য আল্লাহ একটা অ্যালার্ম দিয়েছেন। শুনবেন?"
তিলাওয়াত করলাম অর্থসহ:
"বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় করো এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ করো—আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর নির্দেশ (আযাব) আসা পর্যন্ত।"
পড়তে পড়তে আমার কণ্ঠ ধরে এল। "ভাইয়েরা, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমাদের কাছে আজ কোনটা প্রিয়? ফজরের নামাজের চেয়ে কি ঘুমের আরাম প্রিয় নয়? আল্লাহর হুকুমের চেয়ে কি বসের হুকুম প্রিয় নয়? আমরা তো সেই জাতি, যারা মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-এর উত্তরসূরি। মুসআব (রা.) মক্কার সবচেয়ে হ্যান্ডসাম যুবক ছিলেন। সবচেয়ে দামী সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। সেই মুসআব যখন ইসলাম কবুল করলেন, মা তাকে ত্যাজ্য করল, সম্পদ কেড়ে নিল। উহুদের যুদ্ধে যখন তিনি শহিদ হলেন, তখন তার কাফনের কাপড় এত ছোট ছিল যে, মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যেত, আর পা ঢাকলে মাথা। রাসুল (সা.) কেঁদে বলেছিলেন—'মুসআব! আজ তোমার এই অবস্থা! অথচ মক্কায় তোমার মতো বিলাসী কেউ ছিল না।' কেন তিনি সব ছাড়লেন? কার জন্য?"
ঘরটা একদম নিস্তব্ধ। শুধু বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে। হঠাৎ দেখলাম সাকিবের চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে গেছে। সে চশমা খুলে চোখ মুছল। রিফাত, সেই উদ্ধত রিফাত, তার হাতের ট্যাটুটা আড়াল করার চেষ্টা করছে জামার হাতা টেনে। হয়তো তার মনে হচ্ছে, এই চামড়াটা আল্লাহর আমানত, আর সে তাতে কী একেছে!
তানভীর বলল, "আমরা অনেক ভুল করেছি। অনেক সময় নষ্ট করেছি। কিন্তু আর না। আজ থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করব—আমাদের আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ, হোক সেটা ৫ শতাংশ বা ১০ শতাংশ, আমরা মানুষের কল্যাণে দেব। আর আমরা নিজেদের জানব। পড়ব। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন আমরা এই স্টাডি সার্কেল চালু রাখব।"
সবাই মাথা নাড়ল। রিফাত বলল, "আমি... আমি আসলে বুঝতে পারিনি। আমার স্যালারির অর্ধেকটা আমি এই মাসে ডোনেট করতে চাই। কিন্তু আমি জানি না কোথায় দিতে হবে। তোমরা কি হেল্প করবে?"
আমার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! পাথরের বুক চিরেও ঝরনাধারা বের হতে পারে! রিফাত, যাকে আমি ভেবেছিলাম সবচেয়ে বড় বাধা, সে আজ সবচেয়ে বড় ত্যাগের ঘোষণা দিল।
মিটিং শেষ হলো। সবাই যখন বের হচ্ছে, তখন মনে হলো ওদের কাঁধের ভারটা যেন কিছুটা কমে গেছে। অথবা হয়তো ভারটা বেড়েছে—দায়িত্বের ভার। কিন্তু এই ভার বহন করার মধ্যে এক অদ্ভুত আনন্দ আছে।
বিকেলে অফিস থেকে বের হলাম। বৃষ্টি থামেনি। গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে। আমার ছাতা নেই। হুডিটা মাথায় টেনে নিলাম। রাস্তায় পানি জমে গেছে। রিকশা পাওয়া দুষ্কর। হাঁটতে শুরু করলাম।
হাঁটতে হাঁটতে পকেটে হাত দিলাম। মোবাইলটা বের করলাম। গাজার আপডেট দেখার সাহস হচ্ছে না। তবুও দেখলাম। জাবালিয়া ক্যাম্পে হামলা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে শত শত মানুষ। একটা ভিডিওতে দেখলাম, বৃষ্টির পানিতে তাঁবু ভেসে গেছে। কাদামাটিতে বসে এক শিশু কাঁদছে। তার গায়ে কোনো গরম কাপড় নেই।
আমার গায়ের হুডিটা যেন আগুনের মতো গরম মনে হতে লাগল। আমি এই শহরে, এই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে বাড়ি ফিরব, গরম কফি খাব, লেপের নিচে ঘুমাব। আর ওই শিশুটা?
হঠাৎ মনে পড়ল, আমার বাসায় একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা পড়ে আছে। শখ করে কিনেছিলাম ফটোগ্রাফি করব বলে। গত দুই বছরে ওটা আলমারি থেকে বের করা হয়নি। লেন্সসহ ওটার দাম অন্তত ষাট-সত্তর হাজার টাকা হবে। ওটা দিয়ে আমি কী করব? প্রকৃতির ছবি তুলব? মানুষের হাসিমুখের ছবি তুলব? যেখানে আমার উম্মাহর চেহারা রক্তে মাখা, সেখানে আমি ফুলের ছবি তোলার বিলাসিতা করি কী করে?
সিদ্ধান্ত নিলাম। ওটা বেচে দেব। এখনই।
আমি উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করলাম। ইলেকট্রনিক্স মার্কেটের দিকে। বৃষ্টির ঝাপটা মুখে লাগছে। মনে হচ্ছে এই বৃষ্টি আমার গুনাহগুলো ধুয়ে দিচ্ছে। আমি জানি, ক্যামেরা বিক্রির টাকা দিয়ে গাজা স্বাধীন হবে না। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে যদি একটা তেরপল কেনা যায়, একটা কম্বল কেনা যায়, তবে হাশরের ময়দানে আমি ওই ক্যামেরাটা সাক্ষী হিসেবে পাব না, পাব ওই কম্বলটা।
দোকানে গেলাম। পরিচিত এক বড় ভাই আছেন, যিনি সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যামেরা কেনেন। আমাকে দেখে অবাক হলেন। "কি ভাই, ভিজে একাকার অবস্থা! ক্যামেরা বিক্রি করবেন? নতুন মডেল নেবেন নাকি?"
আমি ক্যামেরাটা কাউন্টারে রাখলাম। "না ভাই, নতুন কিছু নেব না। শুধু বিক্রি করব। ইমার্জেন্সি টাকা দরকার।"
তিনি ক্যামেরাটা নেড়েচেড়ে দেখলেন। "কন্ডিশন তো একদম ফ্রেশ। পঁয়তাল্লিশ হাজার দিতে পারব। এর বেশি হবে না ভাই।"
আমি দরদাম করলাম না। বললাম, "আলহামদুলিল্লাহ। দিন।"
টাকাটা হাতে নিয়ে যখন দোকান থেকে বের হলাম, তখন এক অদ্ভুত হালকাবোধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে পিঠের ওপর থেকে বিশাল এক বোঝা নেমে গেল। আমার প্রিয় শখ, আমার প্যাশন—সবকিছু আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করে দেওয়ার যে স্বাদ, তা কোনো বিরিয়ানি বা ব্র্যান্ডের পোশাকে নেই।
বাসায় ফেরার পথে তানভীরকে ফোন দিলাম।
"দোস্ত, আমার ক্যামেরাটা বেচে দিলাম।"
তানভীর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, "আল্লাহ কবুল করুন দোস্ত। আল্লাহ তোর এই ব্যবসার উত্তম প্রতিদান দিন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন।"
বাসায় ঢুকলাম। মা জায়নামাজে বসে তসবিহ পড়ছিলেন। আমাকে ভেজা অবস্থায় দেখে বললেন, "কিরে, ছাতা নিসনি? জ্বর আসবে তো।"
আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। ভেজা মাথাটা মায়ের কোলে রাখলাম। মা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। এই স্পর্শটা কত শান্তির! গাজার কত সন্তান আজ এই স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। কত মা আজ সন্তানের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
"মা," আমি ফিসফিস করে বললাম।
"বল বাবা।"
"আমাদের কি অনেক বেশি দরকার? বাঁচার জন্য?"
মা হাসলেন। "না রে পাগল। বাঁচার জন্য তো অল্পই দরকার। আমরা তো বাঁচার জন্য খাই না, খাওয়ার জন্য বাঁচি—তাই এত দরকার হয়।"
"মা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার জমানো টাকা আর ক্যামেরা বিক্রির টাকাটা আমি ফিলিস্তিনে পাঠাতে চাই। আমাদের পরিচিত এক এনজিওর ভাই আছেন, যিনি সরাসরি বর্ডারে কাজ করছেন। আমি কি দেব?"
মা আমার মুখটা তুলে ধরলেন। তার চোখে পানি, কিন্তু ঠোঁটে হাসি। "তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস? ওটা তো আল্লাহর মাল। তুই তো শুধু আমানতদার। দিয়ে দে বাবা। সব দিয়ে দে। আল্লাহ যদি আমাদের রিজিকে বরকত দেন, তবে ডাল-ভাতেই পেট ভরবে। আর যদি বরকত না থাকে, তবে পোলাও খেয়েও শান্তি পাবি না।"
মায়ের কথা শুনে আমার ভেতরটা শান্ত হয়ে গেল। মায়েরা আসলে অনেক বড় আলেম। তারা কিতাব না পড়েও ইসলামের নির্যাসটুকু বুঝে ফেলেন।
রাতে ইফতারের সময় (নফল রোজার ইফতার) সামান্য খেজুর আর পানি দিয়ে রোজা ভাঙলাম। রাফিয়া আমার জন্য শরবত বানিয়ে এনেছে। ও ইদানীং খুব চুপচাপ। ওর মোবাইলে এখন আর হিন্দি গানের রিলস বাজে না। ও এখন ফিলিস্তিনের ইতিহাস পড়ছে। গতকাল ও আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, "ভাইয়া, সালাউদ্দিন আইয়ুবী কি সত্যিই একা জেরুজালেম জয় করেছিলেন?" আমি বলেছিলাম, "একা না বোন, তার সাথে ছিল একদল রুহানি সৈনিক, যারা রাতের আঁধারে জায়নামাজ ভেজাত, আর দিনের আলোয় ঘোড়া ছোটাত।"
রাফিয়া তখন বলেছিল, "আমিও কি সেই সৈনিক হতে পারি ভাইয়া? আমার তো ঘোড়া নেই, তলোয়ার নেই।"
আমি বলেছিলাম, "তোর ঘোড়া নেই, কিন্তু তোর লজ্জা আছে, তোর পর্দা আছে। তোর তলোয়ার নেই, কিন্তু তোর কলম আছে, তোর মেধা আছে। তুই তোর জায়গা থেকে যুদ্ধ কর।"
রাফিয়া আজ হিজাব পরে আমার সামনে এসেছে। ঠিকমতো বাঁধতে পারেনি, এলোমেলো হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে ওকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রাজকন্যা মনে হচ্ছে। এই তো বিজয়। এই তো বিপ্লব।
রাতের খাবার শেষে আমি আমার ডায়েরিটা খুললাম। একটা কথা মনে পড়লো, "গল্পগুলো অন্যরকম হতে পারত।" হ্যাঁ, আমাদের গল্পগুলো অন্যরকম হতে পারত। আমরা শুধুই ভোগবাদী প্রাণী হয়ে মরতে পারতাম। কিন্তু আল্লাহ আমাদের দয়া করেছেন। তিনি আমাদের জাগিয়েছেন।
আমি লিখলাম:
শিরোনাম: একটি ক্যামেরা ও কিছু ছেঁড়া স্বপ্ন
"আজ আমি আমার শখের লেন্সটা বিক্রি করে দিলাম। লেন্সটা দিয়ে জুম করলে অনেক দূরের জিনিস কাছে দেখা যেত। কিন্তু আজ আমি লেন্স ছাড়াই অনেক দূরের একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। আমি দেখতে পাচ্ছি—জান্নাতের দরজায় কিছু ধুলোমাখা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গায়ে দামী জ্যাকেট নেই, তাদের পায়ে ব্র্যান্ডের জুতো নেই। কিন্তু তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও উজ্জ্বল। ফেরেশতারা তাদের স্যালুট দিচ্ছে।
আমি কি সেই লাইনে দাঁড়াতে পারব? আমার আমলনামায় তো শুধুই গাফিলতি। কিন্তু হে আল্লাহ! তুমি তো অন্তর্যামী। তুমি জানো, আজ এই শখের বস্তুটা বিক্রি করার সময় আমার একটুও কষ্ট হয়নি। বরং মনে হয়েছে, আমি একটা জান্নাতের টিকেট বুকিং দিলাম।
শীত এখনো আছে। বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু আমার রুহের ভেতরে এখন বসন্তের বাতাস। কারণ আমি বুঝতে শিখেছি—দেওয়ার নামই সুখ, আঁকড়ে ধরার নাম যন্ত্রণা।"
লেখা শেষ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে একটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। ওটা কি ধ্রুবতারা? নাকি ওটা গাজার কোনো এক শহিদি আত্মার আলো?
আমি জানি না। তবে এটুকু জানি, আমাদের এই ছোট ছোট ত্যাগগুলো বৃথা যাবে না। বিন্দু বিন্দু জল দিয়েই সিন্ধু হয়। আমরা হয়তো আবাবিল পাখির মতো ছোট, কিন্তু আমাদের পাথরগুলো যদি সঠিক লক্ষ্যে ছুড়তে পারি, তবে আধুনিক নমরুদদের পতন নিশ্চিত।
তানভীর, সাকিব, রিফাত, রাফিয়া, মা—আমরা সবাই এখন একটা অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা। রুহানিয়ার সুতো। এই সুতো ছিঁড়বে না ইনশাআল্লাহ।
বিছানায় যাওয়ার আগে আমি আমার পুরনো জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। কাল ফজরের নামাজে এই জ্যাকেট পরেই যাব। ইমাম সাহেবের পেছনে দাঁড়িয়ে যখন 'আমিন' বলব, তখন যেন আমার আমিন ধ্বনি গাজার ধ্বংসস্তূপ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
"জেগেছে যুবক, জেগেছে প্রাণ,
শুনছি আবার বিজয়ের গান।
শখের খাঁচা ভেঙেছি আজ,
পরবো না আর মিথ্যে তাজ।
এক আল্লাহ, এক উম্মাহ,
ভয় কি আর? নেই তো ভয়!
রক্তে কেনা এই ঈমান,
আনবে ঠিকই বিশ্বজয়।"
[রুহানিয়া]
[৫]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Comment
Share
Send as a message
Share on my page
Share in the group