শুক্রবার। ছুটির দিন। কিন্তু মুমিনের জীবনে কি আসলে কোনো \'ছুটি\' আছে? শয়তান তো কোনো দিন ছুটি নেয় না। সে শুক্রবারের অলস দুপুরে আমাদের চোখের পাতায় ঘুমের ভারী প্রলেপ লাগিয়ে দেয়, যাতে আমরা জুমার খুতবার সেই বজ্রকঠিন বার্তাগুলো শুনতে না পাই।
আজ কাজিন রেহানের বিয়ে। শহরের সবচেয়ে নামী কনভেনশন হলে আয়োজন। বাবা-মা জোর করেই পাঠালেন। আমার একদম ইচ্ছে ছিল না। যে সময়ে গাজার মায়েরা তাদের সন্তানদের শরীরের টুকরোগুলো পলিথিন ব্যাগে ভরছে, সেই সময়ে আমি কীভাবে গায়ে শেরওয়ানি চাপিয়ে বিরিয়ানির গন্ধে মাতোয়ারা হবো? কিন্তু সামাজিকতা। এই \'সামাজিকতা\' শব্দটা আমাদের ধর্মের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আল্লাহকে নারাজ করতে রাজি, কিন্তু আত্মীয়-স্বজনকে নারাজ করতে পারি না। কী অদ্ভুত আমাদের প্রায়োরিটি!
কনভেনশন হলের গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আলোর ঝলকানি। যেন দিনের আলোকেও হার মানাবে। গেটের দুপাশে বিদেশি ফুলের তোড়া। অথচ এই ফুলগুলো কাল সকালেই ডাস্টবিনে জায়গা পাবে। ভেতরে ঢুকতেই এসির ঠান্ডা হাওয়া। বাইরে মাঘের শীত, ভেতরে কৃত্রিম শীত। হলভর্তি মানুষ। সবার গায়ে দামী দামী পোশাক। বেনারসি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস, স্যুট-কোট। রঙের মেলা। বাতাসে দামী পারফিউমের কড়া গন্ধ। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে হিন্দি গান।
আমি এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজেকে বড্ড বেমানান লাগছে। চারপাশের এই হাসিখুশি মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, আমি কি কোনো ভুল গ্রহে চলে এসেছি? নাকি আমি কোনো মানসিক রোগী, যে সবার মাঝে থেকেও একা?
আমার সামনেই বুফে টেবিল। খাবারের পাহাড়। খাসির লেগ রোস্ট, চিকেন ফ্রাই, কয়েক পদের মাছ, পোলাও, বিরিয়ানি। মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়া ভিড়। প্লেটে খাবার নেওয়ার প্রতিযোগিতা। একজন তার প্লেটে পাহাড় সমান খাবার নিচ্ছে। সে জানে সে এত খেতে পারবে না, তবুও নিচ্ছে। কারণ, \'টাকা দিয়েছি, উসুল করতে হবে\'।
হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছবিটা। গতকাল রাতে ফেসবুকে দেখেছিলাম। উত্তর গাজার এক শিশু। হাড় জিরজিরে শরীর। চামড়াগুলো পাঁজরের সাথে লেগে আছে। তার সামনে একটা বাটিতে কিছু ঘাস সেদ্ধ করা। সে সেটাই খাচ্ছে। তার চোখে কোনো অভিযোগ নেই, আছে শুধু বাঁচার আকুতি।
আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হলো আমি এখনই বমি করে দেব। এই যে আমার সামনে প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে একজন হাসতে হাসতে অর্ধেকটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল—এই দৃশ্যটা আমার কাছে কোনো হরর মুভির চেয়েও ভয়ানক লাগল। আল্লাহ কি আমাদের ধরবেন না? অবশ্যই ধরবেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, \"অতঃপর সেদিন (কিয়ামতের দিন) তোমাদেরকে অবশ্যই নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।\"
এই যে অপচয়, এই যে রিজিকে লাথি মারা—এর হিসাব কি দিতে হবে না?
আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন এক দূর সম্পর্কের চাচা। গায়ে চকচকে মুজিব কোট। পান চিবুচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, \"কিরে বাবা, মন খারাপ নাকি? বিয়েবাড়িতে এমন গোমড়ামুখা হয়ে আছিস কেন? কিছু খাচ্ছিস না?\"
আমি ম্লান হাসলাম। বললাম, \"না চাচা, খিদে নেই।\"
\"আরে, খিদে নেই বললেই হবে? পোলাওয়ের যা সেন্ট বের হয়েছে! শোন, জীবনটা এনজয় করতে হয়। এত ভাবলে চলে না। তোদের জেনারেশনের এই এক সমস্যা, সারাক্ষণ ডিপ্রেশনে থাকিস।\"
আমি চাচাকে কী জবাব দেব? আমি কি তাকে বলব, চাচা, এটা ডিপ্রেশন নয়, এটা ঈমানের জ্বালা? রাসুলুল্লাহ (সা.) কি সাহাবীদের নিয়ে পেট পুরে খেতেন যখন মদিনার কোনো প্রান্তে কেউ না খেয়ে থাকত?
চাচা আবার বললেন, \"শুনলাম তুই নাকি এখন খুব হুজুর হয়ে গেছিস? ভালো ভালো। তবে বাবা, বেশি ডিপে যাস না। ফ্যাসাদ তো আবার বাড়ছে। ইসলাম মানবি, কিন্তু ব্যালেন্স করে। এই যে আমরা নামাজও পড়ি, আবার সমাজও রক্ষা করি। এটাই তো স্মার্ট ইসলাম।\"
\'স্মার্ট ইসলাম\'। শব্দটা শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেল। আমরা নিজেদের সুবিধামতো ইসলামকে মডিফাই করে নিয়েছি। যেখানে সুদ খাওয়া দরকার, সেখানে আমরা বলি \'ব্যাংক ইন্টারেস্ট\'। যেখানে বেপর্দা হওয়া দরকার, সেখানে বলি \'কালচার\'। আর যেখানে অপচয় করা দরকার, সেখানে বলি \'স্ট্যাটাস\'। আমরা আল্লাহর হুকুমকে আমাদের লাইফস্টাইলের ছাঁচে ফেলে কেটেছেঁটে \'স্মার্ট\' বানিয়েছি।
আমি চাচাকে বিনীতভাবে বললাম, \"চাচা, ইসলাম তো ব্যালেন্সের ধর্মই। কিন্তু আমরা ব্যালেন্স করতে গিয়ে কি অন্যায়ের সাথে আপোষ করছি না? এই যে হাজার হাজার টাকার খাবার নষ্ট হচ্ছে, আর ওদিকে আমাদেরই মুসলিম ভাইরা না খেয়ে মরছে—এই ব্যালেন্সটা কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?\"
চাচা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। \"তুই আবার ওই ফিলিস্তিন ইস্যু টেনে আনছিস? আরে বাবা, ওটা ওদের পলিটিক্স। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। এর সাথে আমাদের বিয়েবাড়ির খাবারের কী সম্পর্ক? তুই কি এখান থেকে খাবার পাঠিয়ে দিবি গাজায়? বোকার মতো কথা বলিস না।\"
\"খাবার পাঠাতে পারব না চাচা, কিন্তু অন্তত খাবার নষ্ট না করার শিক্ষাটা তো নিতে পারি। রাসুল (সা.) খাবারের প্লেট চেটে খেতেন, যাতে এক দানা ভাতও নষ্ট না হয়। আর আমরা?\"
চাচা বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বললেন, \"মাথাটা গেছে ছেলেটার।\"
হ্যাঁ, আমার মাথাটা গেছে। এবং আমি চাই এই মাথাটা এভাবেই \'গেছে\' অবস্থায় থাকুক। কারণ সুস্থ মস্তিষ্কে এই অসুস্থ সমাজকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি হল থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলাম। এখানে আওয়াজ একটু কম। আকাশের দিকে তাকালাম। শহরের ধোঁয়ায় আকাশটা ঝাপসা। নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হলো, আল্লাহ কি আমাদের ওপর রাগ করে আসমানের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন? আমরা দোয়া করি, কিন্তু দোয়া কবুল হয় না কেন? কারণ আমাদের পেটে হারাম, গায়ে হারাম, চিন্তায় হারাম।
পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট করল। তানভীরের মেসেজ। একটা ছবি পাঠিয়েছে। ছবিটা জুম করলাম। তানভীরের অফিসের ডেস্ক। সেখানে দুপুরের লাঞ্চের বক্স। কিন্তু বক্সে বিরিয়ানি বা ফাস্ট ফুড নেই। আছে সাধারণ ডাল-ভাত আর সবজি। নিচে ক্যাপশন লিখেছে—\"আজ থেকে লাঞ্চের বাজেট ১০০ টাকা। বাকি ৩০০ টাকা \'প্রজেক্ট রুহানিয়া\' ফান্ডে। দোস্ত, বিশ্বাস কর, ডাল-ভাতে যে এত তৃপ্তি, আগে বুঝিনি।\"
আমার চোখ ভিজে এল। আলহামদুলিল্লাহ। এই তো পরিবর্তন। তানভীর কোনো বড় লেকচার শোনে না, ও শুধু নিজের বিবেককে প্রশ্ন করেছে। আর উত্তরটা পেয়ে গেছে। ছোট ছোট পরিবর্তনই একদিন পাহাড় সমান বিপ্লব আনবে।
বিয়েবাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। এই চাকচিক্য আমাকে শ্বাসরোধ করে মারছে। রাস্তায় নামলাম। রিকশা নিলাম না। হাঁটতে ইচ্ছে করছে। হাঁটার একটা গুণ হলো, এটা মাটির সাথে আমাদের সম্পর্ক মনে করিয়ে দেয়। আমরা এই মাটির তৈরি, আবার এই মাটিতেই মিশে যাব। মাঝখানের সময়টুকু শুধু অহংকার আর বড়াই।
হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে এসে বসলাম। শীতের রাত। পার্কে মানুষ নেই। শুধু দূরে কয়েকজন ছিন্নমূল মানুষ আগুন পোহাচ্ছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এদের জীবন কত কষ্টের। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, হয়তো এরাই আল্লাহর কাছে আমাদের চেয়ে বেশি প্রিয়। কারণ এদের হিসাব কম। এদের অপচয় করার মতো সম্পদ নেই। এদের অহংকার করার মতো স্ট্যাটাস নেই।
সাহাবী আবু যার গিফারী (রা.)-এর কথা মনে পড়ল। তিনি সম্পদ জমা করাকে ভয় পেতেন। তিনি বলতেন, \"আমার বন্ধু (রাসুল সা.) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন আমার ওপরের দিকে না তাকাই (সম্পদে), বরং নিচের দিকে তাকাই।\"
আমরা উল্টোটা করি। আমরা সবসময় দেখি কার গাড়িটা আমার চেয়ে বড়, কার ফ্ল্যাটটা আমার চেয়ে সুন্দর। এই প্রতিযোগিতাই আমাদের শেষ করে দিয়েছে।
হঠাৎ মনে হলো, আমি একা বসে আছি কেন? আমার তো এখন কাজ করার কথা। শুধু নিজে বুঝলে হবে না, অন্যকে বোঝাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? মানুষ তো শুনতে চায় না। মানুষ সত্যকে ভয় পায়।
আমি ফোনটা বের করে নোটপ্যাডে লিখতে শুরু করলাম। কারণ, কলম হলো মুমিনের তরবারি। যখন কথা বলার সুযোগ থাকে না, তখন লিখতে হয়।
শিরোনাম দিলাম: \"আমরা কি রক্তের দাগ ঢাকতে পারফিউম মাখছি?\"
লিখলাম:
\"আজ একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। আলোর বন্যায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার চোখের সামনে ভাসছিল গাজার অন্ধকার গলিগুলো। আমরা প্লেটে খাবার নিয়ে নষ্ট করছি, আর ভাবছি আমরা খুব সভ্য। কিন্তু সভ্যতা কি পোশাকে থাকে? নাকি সভ্যতা থাকে বিবেকে?
প্রিয় ভাই ও বোন, আপনি যখন আপনার বাচ্চার জন্মদিনে হাজার হাজার টাকা খরচ করে কেক কাটেন, তখন কি একবারও মনে পড়ে ওই মায়ের কথা, যার বাচ্চার জন্ম হয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে? আমি বলছি না আনন্দ করবেন না। কিন্তু আনন্দের একটা সীমা থাকা উচিত। আমাদের আনন্দ যেন অন্যের বেদনার কারণ না হয়।
আমরা বয়কট করছি। কোক খাচ্ছি না, কেএফসিতে যাচ্ছি না। আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমরা কি আমাদের নফসকে বয়কট করতে পেরেছি? আমাদের অপচয়, আমাদের গীবত, আমাদের অহংকার—এগুলো কি ইসরায়েলি মিসাইলের চেয়ে কম ধ্বংসাত্মক?
আসুন, আজ রাতে একবার আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিজের ভেতরের মানুষটাকে প্রশ্ন করি—\'আমি কি প্রস্তুত?\' আজ যদি মালাকুল মউত আসেন, আমি কি হাসিমুখে যেতে পারব? নাকি বলব, \'আরেকটু সময় দাও, আমার তো এখনো অনেক শপিং বাকি\'?\"
লেখাটা ফেসবুকে পোস্ট করলাম। জানি না কয়জন পড়বে। হয়তো কেউ \'হা-হা\' রিঅ্যাক্ট দেবে। কেউ হয়তো কমেন্টে লিখবে, \'বেশি বুঝেন কেন?\' কিন্তু যদি একজন মানুষও, মাত্র একজন মানুষও লেখাটা পড়ে তার প্লেটের খাবারটা নষ্ট না করে, তবে সেটাই আমার সার্থকতা।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। মা দরজা খুলে দিলেন। আমার হাতে খাবারের প্যাকেট নেই দেখে অবাক হলেন।
\"বিয়েবাড়ি থেকে কিছু আনলি না? তোর ছোট বোনটা বিরিয়ানি পছন্দ করে।\"
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চুলে পাক ধরেছে। এই মা আমাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছেন। কিন্তু মা-ও তো এই সমাজেরই অংশ। তিনিও চান ছেলে বড় চাকরি করবে, সমাজে নাম হবে।
বললাম, \"মা, আজ থেকে আমরা একটু মিতব্যয়ী হবো। সপ্তাহে এক দিন আমরা মাছ-মাংস খাব না। শুধু ভর্তা-ভাত খাব। আর সেই টাকাটা আমরা জমিয়ে রাখব।\"
মা অবাক হয়ে বললেন, \"কেন? আমাদের কি অভাব পড়েছে?\"
\"অভাব আমাদের পড়েনি মা, অভাব পড়েছে আমাদের ঈমানে। আমরা বড্ড বেশি আরামপ্রিয় হয়ে গেছি। রাসুল (সা.) দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতেন। আর আমরা তিন বেলা রাজকীয় খাবার খেয়েও বলি—\'আল্লাহ কী দিলেন?\' মা, আমি চাই না কিয়ামতের দিন আল্লাহ আমাদের নিয়ামতের হিসাব নিতে গিয়ে আটকে দিন।\"
মায়ের চোখটা ছলছল করে উঠল। মায়েরা সন্তানের কথা বোঝেন। মা কাছে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। \"তুই অনেক বদলে গেছিস রে। তোর বাবার মতো হয়েছিস। তোর বাবাও বলতেন, \'সাদা ভাত আর ডাল, সাথে আল্লাহর শুকরিয়া—এর চেয়ে বড় পোলাও আর হয় না।\'\"
আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। এই প্রথম মনে হলো, আমার যুদ্ধের একজন সেনাপতি আমি পেয়ে গেছি। আমার মা। ঘর থেকেই বিপ্লব শুরু করতে হয়।
ঘরে এসে ওজু করে নিলাম। তাহাজ্জুদের সময় হয়নি, কিন্তু নফল নামাজ পড়া যায়। জায়নামাজে দাঁড়ালাম। সূরা ইখলাস পড়লাম। \"কুল হুয়াল্লাহু আহাদ\"। আল্লাহ এক। অদ্বিতীয়। তার কোনো শরিক নেই।
নামাজ শেষে মোনাজাতে হাত তুললাম। হঠাৎ মনে হলো, আমি কার জন্য দোয়া করব? নিজের জন্য? না। আজ দোয়া করব আমার সেই চাচার জন্য, যিনি আমাকে \'পাগল\' বললেন। দোয়া করব সেই মানুষগুলোর জন্য, যারা খাবার নষ্ট করল। কারণ তারা জানে না তারা কী করছে। তারা গাফলতে (উদাসীনতায়) আছে।
\"হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জাতিকে ক্ষমা করো। আমাদের অন্তর থেকে দুনিয়ার মোহ দূর করে দাও। আমাদের চোখ খুলে দাও। গাজার মাটির নিচে যারা শুয়ে আছে, তাদের উসিলায় আমাদের মৃত অন্তরগুলো জিন্দা করে দাও।\"
কান্না পাচ্ছে না। কান্না শুকিয়ে গেছে। কিন্তু বুকের ভেতর একটা আগুন অনুভব করছি। এই আগুনটা নেভানো যাবে না। এই আগুনটাই আমাকে এগিয়ে নেবে।
বিছানায় শুতে গেলাম। নরম তোশক। কিন্তু পিঠে কাঁটার মতো বিঁধছে। গাজার মানুষরা এখন পাথরের ওপর ঘুমাচ্ছে। আমি বালিশটা সরিয়ে রাখলাম। ফ্লোরে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়লাম। মা দেখলে বকবেন। কিন্তু আজ রাতে আমি একটু কষ্ট করতে চাই। একটু অনুভব করতে চাই—পাথর বিছানা কেমন হয়।
চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। মস্তিষ্কে হাজারো চিন্তা। প্রজেক্ট \'রুহানিয়া\'র পরবর্তী ধাপ কী হবে? মানুষকে শুধু ফেসবুকে লিখে জাগানো যাবে না। মাঠে নামতে হবে। মসজিদগুলোতে যেতে হবে। ইমাম সাহেবদের সাথে কথা বলতে হবে। জুমার খুতবায় যেন ফিলিস্তিন আর আমাদের আত্মশুদ্ধি নিয়ে আরও জোরালো কথা বলা হয়, সে চেষ্টা করতে হবে।
হঠাৎ তানভীরের ফোন। এত রাতে?
\"হ্যালো?\"
\"দোস্ত, ঘুমাসনি?\" তানভীরের গলা উত্তেজিত।
\"না, বল।\"
\"সাকিব আর আমি একটা প্ল্যান করেছি। আমাদের অফিসের কলিগদের নিয়ে একটা \'স্টাডি সার্কেল\' করব। সপ্তাহে একদিন। লাঞ্চ আওয়ারে। আমরা কোনো হুজুর ডাকব না, আমরা নিজেরাই কুরআন পড়ব, হাদিস পড়ব, আর সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তুই থাকবি?\"
বুকটা গর্বে ভরে গেল। \"অবশ্যই থাকব। এটাই তো চাই তানভীর! জ্ঞান অর্জন ছাড়া এই উম্মাহ জাগবে না। আবেগ দিয়ে দুদিন চলা যায়, কিন্তু জ্ঞান দিয়ে শতাব্দী পার করা যায়।\"
\"আরেকটা কথা,\" তানভীর একটু থামল। \"আমার ওয়াইফ... ও আজ আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, \'তুমি ইদানীং এত চুপচাপ কেন?\' আমি ওকে সব খুলে বললাম। ও প্রথমে রাগ করেছিল। কিন্তু পরে যখন গাজার সেই বাচ্চার ছবিটা দেখালাম... ও অনেকক্ষণ কাঁদল। ও বলেছে, আগামী মাসে ও ওর জমানো টাকা দিয়ে এতিমখানায় কিছু শীতের কাপড় দেবে।\"
\"আল্লাহু আকবার!\" আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল।
\"দোস্ত, বরফ গলছে,\" তানভীর বলল।
\"হ্যাঁ, বরফ গলছে। ইনশাআল্লাহ একদিন প্লাবন আসবে।\"
ফোন রাখার পর আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এই হাসিটা বিজয়ের হাসি নয়, এই হাসিটা আশার হাসি। শয়তান আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু সে ভুলে গেছে—মুমিনের ঘুমও ইবাদত, আর জাগরণ হলো বিপ্লব।
বাইরে কুয়াশা বাড়ছে। জানালার কাচে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। আমি আঙুল দিয়ে কাচের ওপর লিখলাম—\"ফিলিস্তিন\"। তারপর মুছে ফেললাম। না, শুধু কাঁচে লিখলে হবে না, হৃদয়ে লিখতে হবে।
কাল সকালে নতুন সূর্য উঠবে। সেই সূর্যের আলোয় আমি আমার পুরনো জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে বের হবো। লোকে হয়তো বলবে \'আনস্মার্ট\'। কিন্তু আমি জানব, আমার এই পুরনো জ্যাকেটের পকেটে আছে এক আকাশ সমান আত্মতৃপ্তি।
কারণ আমি এখন আর দুনিয়ার ব্র্যান্ড খুঁজি না, আমি খুঁজি আল্লাহর সন্তুষ্টির ব্র্যান্ড। আর সেই ব্র্যান্ডের ট্যাগলাইন হলো—\"ইন্নাল্লাহা মা\'আস সাবেরিন\" (নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন)।
আমার যাত্রা শুরু হলো। একা নয়, আমরা এখন দলবদ্ধ। গন্তব্য অনেক দূর। কিন্তু পথ চলাই তো জীবন।
\"ওরা বলে স্বপ্ন দেখা পাপ,
আমি বলি, স্বপ্নই তো জীবনের মাপ।
ওরা গড়ে ইটের পাঁজর, পাথরের ঘর,
আমি গড়বো রুহের মিনার, নেই কোনো ডর।
জেগে ওঠো হে যুবক, সময় যে যায়,
রক্তের দামে কেনা দ্বীন, লুটাবে কি ধুলোয়?\"
[রুহানিয়া]
[৪]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
শুক্রবার। ছুটির দিন। কিন্তু মুমিনের জীবনে কি আসলে কোনো 'ছুটি' আছে? শয়তান তো কোনো দিন ছুটি নেয় না। সে শুক্রবারের অলস দুপুরে আমাদের চোখের পাতায় ঘুমের ভারী প্রলেপ লাগিয়ে দেয়, যাতে আমরা জুমার খুতবার সেই বজ্রকঠিন বার্তাগুলো শুনতে না পাই।
আজ কাজিন রেহানের বিয়ে। শহরের সবচেয়ে নামী কনভেনশন হলে আয়োজন। বাবা-মা জোর করেই পাঠালেন। আমার একদম ইচ্ছে ছিল না। যে সময়ে গাজার মায়েরা তাদের সন্তানদের শরীরের টুকরোগুলো পলিথিন ব্যাগে ভরছে, সেই সময়ে আমি কীভাবে গায়ে শেরওয়ানি চাপিয়ে বিরিয়ানির গন্ধে মাতোয়ারা হবো? কিন্তু সামাজিকতা। এই 'সামাজিকতা' শব্দটা আমাদের ধর্মের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আল্লাহকে নারাজ করতে রাজি, কিন্তু আত্মীয়-স্বজনকে নারাজ করতে পারি না। কী অদ্ভুত আমাদের প্রায়োরিটি!
কনভেনশন হলের গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আলোর ঝলকানি। যেন দিনের আলোকেও হার মানাবে। গেটের দুপাশে বিদেশি ফুলের তোড়া। অথচ এই ফুলগুলো কাল সকালেই ডাস্টবিনে জায়গা পাবে। ভেতরে ঢুকতেই এসির ঠান্ডা হাওয়া। বাইরে মাঘের শীত, ভেতরে কৃত্রিম শীত। হলভর্তি মানুষ। সবার গায়ে দামী দামী পোশাক। বেনারসি, লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস, স্যুট-কোট। রঙের মেলা। বাতাসে দামী পারফিউমের কড়া গন্ধ। আর ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে হিন্দি গান।
আমি এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজেকে বড্ড বেমানান লাগছে। চারপাশের এই হাসিখুশি মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, আমি কি কোনো ভুল গ্রহে চলে এসেছি? নাকি আমি কোনো মানসিক রোগী, যে সবার মাঝে থেকেও একা?
আমার সামনেই বুফে টেবিল। খাবারের পাহাড়। খাসির লেগ রোস্ট, চিকেন ফ্রাই, কয়েক পদের মাছ, পোলাও, বিরিয়ানি। মানুষের হুমড়ি খেয়ে পড়া ভিড়। প্লেটে খাবার নেওয়ার প্রতিযোগিতা। একজন তার প্লেটে পাহাড় সমান খাবার নিচ্ছে। সে জানে সে এত খেতে পারবে না, তবুও নিচ্ছে। কারণ, 'টাকা দিয়েছি, উসুল করতে হবে'।
হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছবিটা। গতকাল রাতে ফেসবুকে দেখেছিলাম। উত্তর গাজার এক শিশু। হাড় জিরজিরে শরীর। চামড়াগুলো পাঁজরের সাথে লেগে আছে। তার সামনে একটা বাটিতে কিছু ঘাস সেদ্ধ করা। সে সেটাই খাচ্ছে। তার চোখে কোনো অভিযোগ নেই, আছে শুধু বাঁচার আকুতি।
আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হলো আমি এখনই বমি করে দেব। এই যে আমার সামনে প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে একজন হাসতে হাসতে অর্ধেকটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল—এই দৃশ্যটা আমার কাছে কোনো হরর মুভির চেয়েও ভয়ানক লাগল। আল্লাহ কি আমাদের ধরবেন না? অবশ্যই ধরবেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, "অতঃপর সেদিন (কিয়ামতের দিন) তোমাদেরকে অবশ্যই নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।"
এই যে অপচয়, এই যে রিজিকে লাথি মারা—এর হিসাব কি দিতে হবে না?
আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন এক দূর সম্পর্কের চাচা। গায়ে চকচকে মুজিব কোট। পান চিবুচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, "কিরে বাবা, মন খারাপ নাকি? বিয়েবাড়িতে এমন গোমড়ামুখা হয়ে আছিস কেন? কিছু খাচ্ছিস না?"
আমি ম্লান হাসলাম। বললাম, "না চাচা, খিদে নেই।"
"আরে, খিদে নেই বললেই হবে? পোলাওয়ের যা সেন্ট বের হয়েছে! শোন, জীবনটা এনজয় করতে হয়। এত ভাবলে চলে না। তোদের জেনারেশনের এই এক সমস্যা, সারাক্ষণ ডিপ্রেশনে থাকিস।"
আমি চাচাকে কী জবাব দেব? আমি কি তাকে বলব, চাচা, এটা ডিপ্রেশন নয়, এটা ঈমানের জ্বালা? রাসুলুল্লাহ (সা.) কি সাহাবীদের নিয়ে পেট পুরে খেতেন যখন মদিনার কোনো প্রান্তে কেউ না খেয়ে থাকত?
চাচা আবার বললেন, "শুনলাম তুই নাকি এখন খুব হুজুর হয়ে গেছিস? ভালো ভালো। তবে বাবা, বেশি ডিপে যাস না। ফ্যাসাদ তো আবার বাড়ছে। ইসলাম মানবি, কিন্তু ব্যালেন্স করে। এই যে আমরা নামাজও পড়ি, আবার সমাজও রক্ষা করি। এটাই তো স্মার্ট ইসলাম।"
'স্মার্ট ইসলাম'। শব্দটা শুনে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেল। আমরা নিজেদের সুবিধামতো ইসলামকে মডিফাই করে নিয়েছি। যেখানে সুদ খাওয়া দরকার, সেখানে আমরা বলি 'ব্যাংক ইন্টারেস্ট'। যেখানে বেপর্দা হওয়া দরকার, সেখানে বলি 'কালচার'। আর যেখানে অপচয় করা দরকার, সেখানে বলি 'স্ট্যাটাস'। আমরা আল্লাহর হুকুমকে আমাদের লাইফস্টাইলের ছাঁচে ফেলে কেটেছেঁটে 'স্মার্ট' বানিয়েছি।
আমি চাচাকে বিনীতভাবে বললাম, "চাচা, ইসলাম তো ব্যালেন্সের ধর্মই। কিন্তু আমরা ব্যালেন্স করতে গিয়ে কি অন্যায়ের সাথে আপোষ করছি না? এই যে হাজার হাজার টাকার খাবার নষ্ট হচ্ছে, আর ওদিকে আমাদেরই মুসলিম ভাইরা না খেয়ে মরছে—এই ব্যালেন্সটা কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?"
চাচা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। "তুই আবার ওই ফিলিস্তিন ইস্যু টেনে আনছিস? আরে বাবা, ওটা ওদের পলিটিক্স। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ। এর সাথে আমাদের বিয়েবাড়ির খাবারের কী সম্পর্ক? তুই কি এখান থেকে খাবার পাঠিয়ে দিবি গাজায়? বোকার মতো কথা বলিস না।"
"খাবার পাঠাতে পারব না চাচা, কিন্তু অন্তত খাবার নষ্ট না করার শিক্ষাটা তো নিতে পারি। রাসুল (সা.) খাবারের প্লেট চেটে খেতেন, যাতে এক দানা ভাতও নষ্ট না হয়। আর আমরা?"
চাচা বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বললেন, "মাথাটা গেছে ছেলেটার।"
হ্যাঁ, আমার মাথাটা গেছে। এবং আমি চাই এই মাথাটা এভাবেই 'গেছে' অবস্থায় থাকুক। কারণ সুস্থ মস্তিষ্কে এই অসুস্থ সমাজকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি হল থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলাম। এখানে আওয়াজ একটু কম। আকাশের দিকে তাকালাম। শহরের ধোঁয়ায় আকাশটা ঝাপসা। নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হলো, আল্লাহ কি আমাদের ওপর রাগ করে আসমানের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন? আমরা দোয়া করি, কিন্তু দোয়া কবুল হয় না কেন? কারণ আমাদের পেটে হারাম, গায়ে হারাম, চিন্তায় হারাম।
পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেট করল। তানভীরের মেসেজ। একটা ছবি পাঠিয়েছে। ছবিটা জুম করলাম। তানভীরের অফিসের ডেস্ক। সেখানে দুপুরের লাঞ্চের বক্স। কিন্তু বক্সে বিরিয়ানি বা ফাস্ট ফুড নেই। আছে সাধারণ ডাল-ভাত আর সবজি। নিচে ক্যাপশন লিখেছে—"আজ থেকে লাঞ্চের বাজেট ১০০ টাকা। বাকি ৩০০ টাকা 'প্রজেক্ট রুহানিয়া' ফান্ডে। দোস্ত, বিশ্বাস কর, ডাল-ভাতে যে এত তৃপ্তি, আগে বুঝিনি।"
আমার চোখ ভিজে এল। আলহামদুলিল্লাহ। এই তো পরিবর্তন। তানভীর কোনো বড় লেকচার শোনে না, ও শুধু নিজের বিবেককে প্রশ্ন করেছে। আর উত্তরটা পেয়ে গেছে। ছোট ছোট পরিবর্তনই একদিন পাহাড় সমান বিপ্লব আনবে।
বিয়েবাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। এই চাকচিক্য আমাকে শ্বাসরোধ করে মারছে। রাস্তায় নামলাম। রিকশা নিলাম না। হাঁটতে ইচ্ছে করছে। হাঁটার একটা গুণ হলো, এটা মাটির সাথে আমাদের সম্পর্ক মনে করিয়ে দেয়। আমরা এই মাটির তৈরি, আবার এই মাটিতেই মিশে যাব। মাঝখানের সময়টুকু শুধু অহংকার আর বড়াই।
হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে এসে বসলাম। শীতের রাত। পার্কে মানুষ নেই। শুধু দূরে কয়েকজন ছিন্নমূল মানুষ আগুন পোহাচ্ছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এদের জীবন কত কষ্টের। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, হয়তো এরাই আল্লাহর কাছে আমাদের চেয়ে বেশি প্রিয়। কারণ এদের হিসাব কম। এদের অপচয় করার মতো সম্পদ নেই। এদের অহংকার করার মতো স্ট্যাটাস নেই।
সাহাবী আবু যার গিফারী (রা.)-এর কথা মনে পড়ল। তিনি সম্পদ জমা করাকে ভয় পেতেন। তিনি বলতেন, "আমার বন্ধু (রাসুল সা.) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন আমার ওপরের দিকে না তাকাই (সম্পদে), বরং নিচের দিকে তাকাই।"
আমরা উল্টোটা করি। আমরা সবসময় দেখি কার গাড়িটা আমার চেয়ে বড়, কার ফ্ল্যাটটা আমার চেয়ে সুন্দর। এই প্রতিযোগিতাই আমাদের শেষ করে দিয়েছে।
হঠাৎ মনে হলো, আমি একা বসে আছি কেন? আমার তো এখন কাজ করার কথা। শুধু নিজে বুঝলে হবে না, অন্যকে বোঝাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? মানুষ তো শুনতে চায় না। মানুষ সত্যকে ভয় পায়।
আমি ফোনটা বের করে নোটপ্যাডে লিখতে শুরু করলাম। কারণ, কলম হলো মুমিনের তরবারি। যখন কথা বলার সুযোগ থাকে না, তখন লিখতে হয়।
শিরোনাম দিলাম: "আমরা কি রক্তের দাগ ঢাকতে পারফিউম মাখছি?"
লিখলাম:
"আজ একটা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলাম। আলোর বন্যায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার চোখের সামনে ভাসছিল গাজার অন্ধকার গলিগুলো। আমরা প্লেটে খাবার নিয়ে নষ্ট করছি, আর ভাবছি আমরা খুব সভ্য। কিন্তু সভ্যতা কি পোশাকে থাকে? নাকি সভ্যতা থাকে বিবেকে?
প্রিয় ভাই ও বোন, আপনি যখন আপনার বাচ্চার জন্মদিনে হাজার হাজার টাকা খরচ করে কেক কাটেন, তখন কি একবারও মনে পড়ে ওই মায়ের কথা, যার বাচ্চার জন্ম হয়েছে ধ্বংসস্তূপের নিচে? আমি বলছি না আনন্দ করবেন না। কিন্তু আনন্দের একটা সীমা থাকা উচিত। আমাদের আনন্দ যেন অন্যের বেদনার কারণ না হয়।
আমরা বয়কট করছি। কোক খাচ্ছি না, কেএফসিতে যাচ্ছি না। আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমরা কি আমাদের নফসকে বয়কট করতে পেরেছি? আমাদের অপচয়, আমাদের গীবত, আমাদের অহংকার—এগুলো কি ইসরায়েলি মিসাইলের চেয়ে কম ধ্বংসাত্মক?
আসুন, আজ রাতে একবার আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিজের ভেতরের মানুষটাকে প্রশ্ন করি—'আমি কি প্রস্তুত?' আজ যদি মালাকুল মউত আসেন, আমি কি হাসিমুখে যেতে পারব? নাকি বলব, 'আরেকটু সময় দাও, আমার তো এখনো অনেক শপিং বাকি'?"
লেখাটা ফেসবুকে পোস্ট করলাম। জানি না কয়জন পড়বে। হয়তো কেউ 'হা-হা' রিঅ্যাক্ট দেবে। কেউ হয়তো কমেন্টে লিখবে, 'বেশি বুঝেন কেন?' কিন্তু যদি একজন মানুষও, মাত্র একজন মানুষও লেখাটা পড়ে তার প্লেটের খাবারটা নষ্ট না করে, তবে সেটাই আমার সার্থকতা।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। মা দরজা খুলে দিলেন। আমার হাতে খাবারের প্যাকেট নেই দেখে অবাক হলেন।
"বিয়েবাড়ি থেকে কিছু আনলি না? তোর ছোট বোনটা বিরিয়ানি পছন্দ করে।"
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চুলে পাক ধরেছে। এই মা আমাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছেন। কিন্তু মা-ও তো এই সমাজেরই অংশ। তিনিও চান ছেলে বড় চাকরি করবে, সমাজে নাম হবে।
বললাম, "মা, আজ থেকে আমরা একটু মিতব্যয়ী হবো। সপ্তাহে এক দিন আমরা মাছ-মাংস খাব না। শুধু ভর্তা-ভাত খাব। আর সেই টাকাটা আমরা জমিয়ে রাখব।"
মা অবাক হয়ে বললেন, "কেন? আমাদের কি অভাব পড়েছে?"
"অভাব আমাদের পড়েনি মা, অভাব পড়েছে আমাদের ঈমানে। আমরা বড্ড বেশি আরামপ্রিয় হয়ে গেছি। রাসুল (সা.) দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতেন। আর আমরা তিন বেলা রাজকীয় খাবার খেয়েও বলি—'আল্লাহ কী দিলেন?' মা, আমি চাই না কিয়ামতের দিন আল্লাহ আমাদের নিয়ামতের হিসাব নিতে গিয়ে আটকে দিন।"
মায়ের চোখটা ছলছল করে উঠল। মায়েরা সন্তানের কথা বোঝেন। মা কাছে এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। "তুই অনেক বদলে গেছিস রে। তোর বাবার মতো হয়েছিস। তোর বাবাও বলতেন, 'সাদা ভাত আর ডাল, সাথে আল্লাহর শুকরিয়া—এর চেয়ে বড় পোলাও আর হয় না।'"
আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। এই প্রথম মনে হলো, আমার যুদ্ধের একজন সেনাপতি আমি পেয়ে গেছি। আমার মা। ঘর থেকেই বিপ্লব শুরু করতে হয়।
ঘরে এসে ওজু করে নিলাম। তাহাজ্জুদের সময় হয়নি, কিন্তু নফল নামাজ পড়া যায়। জায়নামাজে দাঁড়ালাম। সূরা ইখলাস পড়লাম। "কুল হুয়াল্লাহু আহাদ"। আল্লাহ এক। অদ্বিতীয়। তার কোনো শরিক নেই।
নামাজ শেষে মোনাজাতে হাত তুললাম। হঠাৎ মনে হলো, আমি কার জন্য দোয়া করব? নিজের জন্য? না। আজ দোয়া করব আমার সেই চাচার জন্য, যিনি আমাকে 'পাগল' বললেন। দোয়া করব সেই মানুষগুলোর জন্য, যারা খাবার নষ্ট করল। কারণ তারা জানে না তারা কী করছে। তারা গাফলতে (উদাসীনতায়) আছে।
"হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জাতিকে ক্ষমা করো। আমাদের অন্তর থেকে দুনিয়ার মোহ দূর করে দাও। আমাদের চোখ খুলে দাও। গাজার মাটির নিচে যারা শুয়ে আছে, তাদের উসিলায় আমাদের মৃত অন্তরগুলো জিন্দা করে দাও।"
কান্না পাচ্ছে না। কান্না শুকিয়ে গেছে। কিন্তু বুকের ভেতর একটা আগুন অনুভব করছি। এই আগুনটা নেভানো যাবে না। এই আগুনটাই আমাকে এগিয়ে নেবে।
বিছানায় শুতে গেলাম। নরম তোশক। কিন্তু পিঠে কাঁটার মতো বিঁধছে। গাজার মানুষরা এখন পাথরের ওপর ঘুমাচ্ছে। আমি বালিশটা সরিয়ে রাখলাম। ফ্লোরে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়লাম। মা দেখলে বকবেন। কিন্তু আজ রাতে আমি একটু কষ্ট করতে চাই। একটু অনুভব করতে চাই—পাথর বিছানা কেমন হয়।
চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু ঘুম আসছে না। মস্তিষ্কে হাজারো চিন্তা। প্রজেক্ট 'রুহানিয়া'র পরবর্তী ধাপ কী হবে? মানুষকে শুধু ফেসবুকে লিখে জাগানো যাবে না। মাঠে নামতে হবে। মসজিদগুলোতে যেতে হবে। ইমাম সাহেবদের সাথে কথা বলতে হবে। জুমার খুতবায় যেন ফিলিস্তিন আর আমাদের আত্মশুদ্ধি নিয়ে আরও জোরালো কথা বলা হয়, সে চেষ্টা করতে হবে।
হঠাৎ তানভীরের ফোন। এত রাতে?
"হ্যালো?"
"দোস্ত, ঘুমাসনি?" তানভীরের গলা উত্তেজিত।
"না, বল।"
"সাকিব আর আমি একটা প্ল্যান করেছি। আমাদের অফিসের কলিগদের নিয়ে একটা 'স্টাডি সার্কেল' করব। সপ্তাহে একদিন। লাঞ্চ আওয়ারে। আমরা কোনো হুজুর ডাকব না, আমরা নিজেরাই কুরআন পড়ব, হাদিস পড়ব, আর সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তুই থাকবি?"
বুকটা গর্বে ভরে গেল। "অবশ্যই থাকব। এটাই তো চাই তানভীর! জ্ঞান অর্জন ছাড়া এই উম্মাহ জাগবে না। আবেগ দিয়ে দুদিন চলা যায়, কিন্তু জ্ঞান দিয়ে শতাব্দী পার করা যায়।"
"আরেকটা কথা," তানভীর একটু থামল। "আমার ওয়াইফ... ও আজ আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, 'তুমি ইদানীং এত চুপচাপ কেন?' আমি ওকে সব খুলে বললাম। ও প্রথমে রাগ করেছিল। কিন্তু পরে যখন গাজার সেই বাচ্চার ছবিটা দেখালাম... ও অনেকক্ষণ কাঁদল। ও বলেছে, আগামী মাসে ও ওর জমানো টাকা দিয়ে এতিমখানায় কিছু শীতের কাপড় দেবে।"
"আল্লাহু আকবার!" আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল।
"দোস্ত, বরফ গলছে," তানভীর বলল।
"হ্যাঁ, বরফ গলছে। ইনশাআল্লাহ একদিন প্লাবন আসবে।"
ফোন রাখার পর আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এই হাসিটা বিজয়ের হাসি নয়, এই হাসিটা আশার হাসি। শয়তান আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু সে ভুলে গেছে—মুমিনের ঘুমও ইবাদত, আর জাগরণ হলো বিপ্লব।
বাইরে কুয়াশা বাড়ছে। জানালার কাচে বিন্দু বিন্দু জল জমেছে। আমি আঙুল দিয়ে কাচের ওপর লিখলাম—"ফিলিস্তিন"। তারপর মুছে ফেললাম। না, শুধু কাঁচে লিখলে হবে না, হৃদয়ে লিখতে হবে।
কাল সকালে নতুন সূর্য উঠবে। সেই সূর্যের আলোয় আমি আমার পুরনো জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে বের হবো। লোকে হয়তো বলবে 'আনস্মার্ট'। কিন্তু আমি জানব, আমার এই পুরনো জ্যাকেটের পকেটে আছে এক আকাশ সমান আত্মতৃপ্তি।
কারণ আমি এখন আর দুনিয়ার ব্র্যান্ড খুঁজি না, আমি খুঁজি আল্লাহর সন্তুষ্টির ব্র্যান্ড। আর সেই ব্র্যান্ডের ট্যাগলাইন হলো—"ইন্নাল্লাহা মা'আস সাবেরিন" (নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন)।
আমার যাত্রা শুরু হলো। একা নয়, আমরা এখন দলবদ্ধ। গন্তব্য অনেক দূর। কিন্তু পথ চলাই তো জীবন।
"ওরা বলে স্বপ্ন দেখা পাপ,
আমি বলি, স্বপ্নই তো জীবনের মাপ।
ওরা গড়ে ইটের পাঁজর, পাথরের ঘর,
আমি গড়বো রুহের মিনার, নেই কোনো ডর।
জেগে ওঠো হে যুবক, সময় যে যায়,
রক্তের দামে কেনা দ্বীন, লুটাবে কি ধুলোয়?"
[রুহানিয়া]
[৪]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Comment
Share
Send as a message
Share on my page
Share in the group