আপনার কি কখনো গোধূলির আকাশটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়েছে? কিংবা বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে—এই মহাবিশ্বে আমি ধূলিকণার চেয়েও ক্ষুদ্র?
সম্ভবত না। কারণ, আমাদের চোখ এখন আর আকাশ দেখে না, আমাদের চোখ এখন সিসি ক্যামেরার মনিটরে, শেয়ার বাজারের সূচকে, কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাইক আর কমেন্টের ভিড়ে আটকে আছে।
আমরা এখন পাওয়ার বা ক্ষমতায় বিশ্বাসী। এই যে আপনি, হয়তো কোনো এক বিশাল কর্পোরেট অফিসের ধবধবে সাদা চেয়ারটায় বসে আছেন। গ্লাস ডোরের ওপাশে শত শত মানুষ আপনার হুকুমের অপেক্ষায়। আপনি কলম ঘোরালে কারো ভাগ্য খোলে, কারো কপাল পোড়ে।
কিংবা আপনি হয়তো প্রশাসনের কোনো উচ্চ পদে, অথবা রাজনীতির মাঠে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। আপনার গাড়ির হর্নে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়, আপনার নাম শুনলে মানুষের পিলে চমকে ওঠে।
এই ক্ষমতা, এই প্রতিপত্তি—এগুলো এক অদ্ভুত নেশা। হেরোইনের চেয়েও মারাত্মক। এই নেশা একবার যাকে পেয়ে বসে, সে আর নিজেকে মানুষ মনে করে না; সে নিজেকে ভাবে \'রব\'।
না, সে মুখে হয়তো বলে না \"আমি তোমাদের রব\", কিন্তু তার আচরণ, তার দম্ভ, আর তার দিগি্বদিগহীন ছুটে চলা বলে দেয়—সে নিজেকে অবিনশ্বর ভাবছে। সে ভাবছে, এই সূর্যটা বোধহয় তার হুকুমে ওঠে, এই বাতাস তার অনুমতি নিয়ে বয়।
কিন্তু রবকে ভুলে যাওয়ার এই যে আয়োজন, এই যে ক্ষমতার মস্ত বড় প্রদর্শনী—এর শেষটা কোথায়?
আসুন, একটু ইতিহাসের ধুলোবালি ঘেঁটে দেখি। ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর শিক্ষক, সে কাউকে ক্ষমা করে না। আপনি নমরুদের কথা জানেন। সেই নমরুদ, যার ক্ষমতার দাপটে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খেত। সে কি আজকের দিনের কোনো সাধারণ নেতার মতো ছিল?
মোটেও না। তার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। সে আকাশের দিকে তীর ছুড়েছিল। ভাবুন তো, কতটা স্পর্ধা থাকলে, কতটা মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে একজন মানুষ আকাশের মালিককে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
নমরুদ ভেবেছিল তার রাজপ্রাসাদ, তার সেনাবাহিনী, তার অঢেল সম্পদ তাকে রক্ষা করবে। সে ইব্রাহিম (আ.)-এর দাওয়াতকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিল। তার যুক্তি ছিল খুব সরল কিন্তু ভয়ংকর—\"জীবন ও মৃত্যু তো আমার হাতে। আমি যাকে চাই মারতে পারি, যাকে চাই বাঁচাতে পারি।\"
আজকের আধুনিক নমরুদরাও কি একই কথা ভাবছে না?
আজকের যুগে যারা ক্ষমতার মসনদে বসে আছে, তারা কি ভাবছে না—\"এই অর্থনীতির চাকা আমার হাতে, এই মিডিয়া আমার কথায় চলে, এই পারমাণবিক বোমার সুইচ আমার পকেটে। আমিই তো সব!\"?
কিন্তু নমরুদের পতন কীভাবে হয়েছিল? কোনো বিশাল উল্কাপাত তাকে ধ্বংস করেনি। কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী এসে তাকে লেজার দিয়ে ভস্ম করে দেয়নি। তাকে ধ্বংস করেছিল অতি ক্ষুদ্র, তুচ্ছ এক মশা।
হ্যাঁ, একটি মশা। যে মশাটিকে আপনি হাতের আলতো থাপ্পড়ে মেরে ফেলেন, সেই মশাই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাধর স্বৈরাচারকে পাগল বানিয়ে দিয়েছিল। মশাটি তার নাকে ঢুকে মগজে কামড়াত। আর সেই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে নমরুদ তার নিজের মাথায় জুতো দিয়ে আঘাত করার নির্দেশ দিত। ভাবা যায়? যে মাথায় রাজমুকুট ছিল, যে মাথায় অহংকারের আকাশচুম্বী দম্ভ ছিল, সেই মাথায় নিজের খাদেমের জুতোর বাড়ি খেয়ে তাকে মরতে হয়েছে।
রব এভাবেই শিক্ষা দেন। তিনি দেখান যে, তোমার পারমাণবিক বোমা, তোমার ড্রোন টেকনোলজি, তোমার স্যাটেলাইট নজরদারি—সবই অসার, যদি আমি একটি অদৃশ্য ভাইরাস বা একটি ক্ষুদ্র মশা লেলিয়ে দেই।
আর ফেরাউন? তার ক্ষমতার ব্যাপ্তি ছিল আরও ভয়ানক। সে তো নিজেকে সরাসরি খোদাই দাবি করে বসেছিল। নীল নদের পানি তার হুকুমে প্রবাহিত হয়—এমনটাই সে বিশ্বাস করাতো তার প্রজাদের। তার ইমান ছিল না, ছিল কেবল ক্ষমতার অন্ধ মোহ। সে মুসা (আ.)-কে জাদুকর ভেবেছিল, সত্যকে ভেবেছিল প্রলাপ।
ফেরাউন যখন সাগরের বুক চিরে তৈরি হওয়া রাস্তার মাঝখানে, তখনো তার হুঁশ ফিরল না। দুপাশে পানির বিশাল দেয়াল, মাঝখানে সে এবং তার অহংকার। সে ভাবল, \"প্রকৃতিও আমাকে ভয় পায়।\" কিন্তু যখন পানি আছড়ে পড়ল, যখন নোনা জল তার ফুসফুসে ঢুকতে শুরু করল, তখন সে চিৎকার করে বলেছিল—\"আমি মুসার রবের প্রতি ইমান আনলাম।\" কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তওবার দরজা তখন বন্ধ।
এখন প্রশ্ন হলো, নমরুদ আর ফেরাউন কি মরে গেছে?
ইতিহাস বলে—হ্যাঁ, তারা মৃত। কিন্তু আধ্যাত্মিক দষ্টিতে তাকালে দেখবেন—না, তারা মরেনি। তাদের শরীর পচে গলে গেছে, মমি হয়ে মিউজিয়ামে পড়ে আছে, কিন্তু তাদের \'আত্মা\' বা তাদের \'প্রেতাত্মা\' আজও বেঁচে আছে।
আজকের সমাজে তাকালে আপনি ভূরি ভূরি নমরুদ আর ফেরাউন দেখতে পাবেন। এরা কারা?
এরা তারাই, যারা ক্ষমতার চেয়ারে বসে ন্যায়-অন্যায় ভুলে যায়। যারা ভাবে, \"আমাকে ধরার কেউ নেই।\" যারা কলমের খোঁচায় এতিমের সম্পদ গ্রাস করে নেয়। যারা নিরপরাধ মানুষকে জেলের অন্ধকারে পচিয়ে মারে। যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য পুরো একটা জনপদকে ধ্বংস করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
আপনি কি ভাবছেন নমরুদ শুধু রাষ্ট্র চালায়?
না। আপনার আমার ভেতরেও একটা করে নমরুদ বাস করে। যখন আপনি আপনার অধীনস্থ কর্মচারীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, তখন আপনি নমরুদ। যখন আপনি আপনার স্ত্রীর বা সন্তানের ন্যায্য অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করেন শুধু আপনার পাওয়ার আছে বলে, তখন আপনি ফেরাউনের উত্তরসূরি। যখন আপনি রবের দেওয়া রিজিক খেয়ে রবেরই বিধানকে উপহাস করেন, তখন আপনার আর আবু লাহাবের মধ্যে পার্থক্য থাকে না।
ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। একে বলা হয় \'ইস্তিদ্রাজ\' বা ঢিল দেওয়া। আল্লাহ মাঝে মাঝে জালিমকে দড়ি আলগা করে দেন। তাকে উপরে উঠতে দেন। সে উঠতে থাকে, উঠতে থাকে। সে ভাবে, \"আল্লাহ যদি থাকতেন, তাহলে তো আমাকে শাস্তি দিতেন। কই, আমার তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না! আমার ব্যাংক ব্যালেন্স তো বাড়ছেই, আমার শরীর তো সুস্থই আছে।\"
সে জানে না, সে আসলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে না, সে উঠছে এক ভয়ংকর খাদের কিনারায়। যত উপরে সে উঠবে, তার পতনের শব্দ তত বিকট হবে। রব তাকে ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না।
বাস্তবতার দিকে তাকান। হাসপাতালের আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছেন কখনো? সেখানে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকান। গতকালও হয়তো তিনি ছিলেন কোনো এক বিশাল শিল্পগোষ্ঠীর মালিক। তার এক ইশারায় হাজার হাজার কোটি টাকার ডিল হতো। আর আজ? আজ তার নিজের নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। মেশিনের পাইপ তার নাকে, মুখে। ভেন্টিলেটরের যান্ত্রিক শব্দে তার জীবন ঝুলে আছে।
কোথায় তার সেই ক্ষমতা? কোথায় তার সেই হুঙ্কার? যে আঙুল উঁচিয়ে তিনি ধমক দিতেন, সেই আঙুলটি নাড়ানোর শক্তিও আজ তার নেই। ডাক্তাররা যখন বলে, \"সরি, আমাদের আর কিছু করার নেই\"—তখন তার হাজার কোটি টাকা, তার মন্ত্রিত্ব, তার গদি—সবই এক দলা থুতুর চেয়েও মূল্যহীন মনে হয়।
রবকে ভুলে যাওয়ার মাসুল এভাবেই দিতে হয়। আমরা ভুলে যাই যে, আমাদের এই সাজানো জীবনটা আসলে মাকড়সার জালের মতো। বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর জ্যামিতিক নকশা, কিন্তু সামান্য বাতাসের ঝাপটায় তা ছিঁড়ে তছনছ হয়ে যায়।
একটা ভাইরাসের কথাই ধরুন না। করোনা এসে আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে গেল?
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো, যাদের পারমাণবিক বোমার ভাণ্ডার দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব, তারা একটা আণুবীক্ষণিক জীবাণুর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, তাদের অহংকারী বিজ্ঞান—সবই অসহায় হয়ে পড়ল। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ রাস্তায় কাতরালো। কই, নমরুদের উত্তরসূরিরা তো বাতাস তৈরি করতে পারল না?
তবুও আমাদের শিক্ষা হয় না। আমরা ভুলে যাই। মানুষের সবচেয়ে বড় রোগ হলো \'বিস্মৃতি\'। আমরা রবকে ভুলে যাই, আখেরাতকে ভুলে যাই, কবরের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারকে ভুলে যাই।
একবার ভাবুন তো কবরের কথা। না, ভৌতিক কোনো গল্পের মতো করে নয়। বাস্তবিক চিন্তা করুন। আজ যে শরীরটাকে আপনি দামী লোশন মাখাচ্ছেন, জিম করে ফিট রাখছেন, যে চেহারার যত্ন নিতে হাজার টাকা খরচ করছেন—সেই শরীরটা মাটির নিচে শুয়ে থাকবে। একা। কোনো এসি নেই, কোনো ফ্যান নেই, কোনো লোশন নেই। আছে শুধু মাটি আর পোকামাকড়।
আপনার এই ক্ষমতা, এই দাপট কি মাটির পোকাদের থামাতে পারবে? তারা যখন আপনার চোখটা খুবলে খাবে, তখন কি আপনি বলতে পারবেন—\"স্টপ! ডু ইউ নো হু আই এম? আমি অমুক কোম্পানির সিইও!\"?
পারবেন না। সেখানে আপনার পরিচয় আপনার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে হবে না। সেখানে আপনার পরিচয় হবে আপনার \'ঈমান\' দিয়ে।
ফেরাউন আজ মিশরের জাদুঘরে শুয়ে আছে। তার শরীরটা অক্ষত রাখা হয়েছে। কেন জানেন? এটা রবের একটা নিদর্শন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, তিনি ফেরাউনের লাশকে সংরক্ষণ করবেন যাতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
প্রতিদিন হাজার হাজার টুরিস্ট ফেরাউনের মমি দেখতে যায়। তারা তাকে দেখে কী ভাবে? তারা কি তাকে সম্মান করে?
না। তারা তাকে দেখে একটা মৃত, অসহায় বস্তু হিসেবে। কেউ কেউ হয়তো করুণার দৃষ্টিতে তাকায়। ভাবুন তো, যে লোকটা নিজেকে খোদা দাবি করেছিল, আজ সে একটা কাঁচের বাক্সে বন্দি, মানুষের দেখার খোরাক। এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে?
অথচ, যারা ঈমান এনেছিল, যারা ক্ষমতার দাপটে নত হয়নি, যেমন আসিয়া (আ.)—ফেরাউনের স্ত্রী। তিনি রাজপ্রাসাদের আরাম-আয়েশ লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলেন সত্যের জন্য। ফেরাউন তাকে মরুভূমির তপ্ত বালুতে শুইয়ে বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়ে হত্যা করেছিল। কিন্তু আসিয়া (আ.) কি হেরে গেছেন?
না। আজ হাজার বছর পরেও কোটি কোটি মানুষ আসিয়া (আ.)-এর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। জান্নাতে তার জন্য ঘর তৈরি হয়ে আছে।
ক্ষমতা আসলে কার? যে জোর করে শরীর দখল করে, তার? নাকি যে আত্মা জয় করে নেয়, তার?
নমরুদ, ফেরাউনরা শরীর দখল করতে চেয়েছিল, কিন্তু মুসা (আ.) বা ইব্রাহিম (আ.) মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন রবের ভালোবাসা দিয়ে।
আজকের যুগে আমাদের চারপাশটা বড় বেশি চাকচিক্যময়। কৃত্রিম আলোয় আমরা আসল আলো হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের পকেটে ক্রেডিট কার্ড আছে, কিন্তু হৃদয়ে \'ক্রেডিট\' নেই। আমাদের সোশাল মিডিয়ায় হাজার হাজার ফলোয়ার আছে, কিন্তু জানাজার নামাজে দাঁড়ানোর মতো খাঁটি মানুষ নেই।
আমরা রবকে ভুলে গিয়েছি কারণ আমরা কারণকে কর্তা বানিয়ে ফেলেছি। আমরা মনে করি, \"আমি পরিশ্রম করেছি তাই সফল হয়েছি।\" \"আমার বুদ্ধিতেই এই প্রজেক্টটা পাশ হয়েছে।\" অবশ্যই পরিশ্রমের দাম আছে, কিন্তু সেই পরিশ্রম করার শক্তিটা কে দিল? সেই বুদ্ধিটা কার দান?
মস্তিষ্কের একটা অতি সূক্ষ্ম শিরা যদি ছিঁড়ে যায়, আপনার এই বিশ্বজয়ী বুদ্ধি মুহূর্তে লোপ পাবে। আপনি পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরবেন। এই যে শিরাটা ছিঁড়ছে না, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক আছে—এটা কার দয়া? এটা কি আপনার কৃতিত্ব?
অথচ এই সুস্থ মস্তিষ্ক দিয়ে আপনি রবের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন। আপনি ভাবছেন, বিজ্ঞানই সব। বিজ্ঞান তো কেবল রবের সৃষ্টির ব্যাখ্যা দেয় মাত্র, বিজ্ঞান তো স্রষ্টা নয়।
যারা ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছে, তাদের জন্য এই দিনগুলো বড় পরীক্ষার। ক্ষমতা হলো আগুনের মতো। এতে রান্নাও করা যায়, আবার এতে ঘরও পোড়ানো যায়। যার হাতে ক্ষমতা আছে, তার কাঁধে দায়িত্বের বোঝা পাহাড়সমান।
হযরত উমর (রা.)-এর কথা মনে পড়ে? অর্ধ পৃথিবীর শাসক ছিলেন তিনি। অথচ তিনি রাতে ঘুমাতে পারতেন না। তিনি বলতেন, \"ফোরাত নদীর তীরে যদি একটা কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তবে কেয়ামতের দিন উমরকে তার জবাবদিহি করতে হবে।\"
আর আজকের শাসকরা? আজকের ক্ষমতাধররা? তাদের প্রাসাদের পাশেই মানুষ না খেয়ে মরে, ন্যায়বিচার না পেয়ে কাঁদে। আর তারা তখন ব্যস্ত থাকে নিজেদের ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করার ষড়যন্ত্রে। তারা ভুলে যায়, এই দিনই শেষ দিন নয়। বিচারক একজন আছেন, যার এজলাসে কোনো উকিল নেই, কোনো মিথ্যা সাক্ষ্য নেই, কোনো ঘুষ চলে না।
সেখানে ফেরাউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। নমরুদ তার রাজত্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আর আপনি? আপনি আপনার পদ-পদবি, আপনার পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। সেখানে কথা বলবে আপনার হাত, আপনার পা, আপনার চামড়া।
আমরা বড় আজব এক সময়ে বাস করছি। এখানে পাপকে বলা হয় \'স্মার্টনেস\', আর ঈমানকে বলা হয় \'ব্যাকডেটেড\'। এখানে সুদ খাওয়াকে বলা হয় \'বিজনেস স্ট্র্যাটেজি\', আর পর্দা করাকে বলা হয় \'রক্ষণশীলতা\'। এই উল্টো স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা ভাবছি আমরা খুব প্রগতিশীল।
আসলে আমরা প্রগতিশীল নই, আমরা \'পতনশীল\'। আমরা সেই খাদের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি, যে খাদে নমরুদ আর ফেরাউন তলিয়ে গিয়েছিল।
ক্ষমতার এই দিনে রবকে ভুলে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কারণ শয়তান আমাদের সামনে এই মরিচিকাটাকে খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করে। সে বলে, \"উপভোগ করো। এই তো সময়। জীবন একটাই।\"
হ্যাঁ, জীবন একটাই। আর তাই এই এক জীবনকে জুয়ার টেবিলে বাজি ধরাটা কি বোকামি নয়? অনন্তকালের জীবনের বিনিময়ে এই ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতার স্বাদ নেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?
একবার ভাবুন, আজ থেকে ১০০ বছর পর আপনার এই ক্ষমতা, এই দাপট, এই নামডাক—কোথায় থাকবে? আপনার কবরের নামফলকটাও হয়তো মুছে যাবে। আপনার হাড়গোড় মাটির সাথে মিশে যাবে। পৃথিবীর মানুষ আপনাকে মনে রাখবে না। ঠিক যেমন আপনি আপনার দাদার বাবার নাম মনে রাখেননি।
কিন্তু একজন মনে রাখবেন। তিনি রব। তিনি ভুলেন না। তিনি সব লিখে রাখছেন। আপনার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, আপনার মনের প্রতিটি গোপন অহংকার, ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতিটি মুহূর্ত—সব রেকর্ড হচ্ছে।
[ক্ষমতার মরীচিকা ও বিস্মৃত নফসের আহাজারি
(১ম পর্ব)]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
আপনার কি কখনো গোধূলির আকাশটার দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়েছে? কিংবা বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে—এই মহাবিশ্বে আমি ধূলিকণার চেয়েও ক্ষুদ্র?
সম্ভবত না। কারণ, আমাদের চোখ এখন আর আকাশ দেখে না, আমাদের চোখ এখন সিসি ক্যামেরার মনিটরে, শেয়ার বাজারের সূচকে, কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লাইক আর কমেন্টের ভিড়ে আটকে আছে।
আমরা এখন পাওয়ার বা ক্ষমতায় বিশ্বাসী। এই যে আপনি, হয়তো কোনো এক বিশাল কর্পোরেট অফিসের ধবধবে সাদা চেয়ারটায় বসে আছেন। গ্লাস ডোরের ওপাশে শত শত মানুষ আপনার হুকুমের অপেক্ষায়। আপনি কলম ঘোরালে কারো ভাগ্য খোলে, কারো কপাল পোড়ে।
কিংবা আপনি হয়তো প্রশাসনের কোনো উচ্চ পদে, অথবা রাজনীতির মাঠে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। আপনার গাড়ির হর্নে রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়, আপনার নাম শুনলে মানুষের পিলে চমকে ওঠে।
এই ক্ষমতা, এই প্রতিপত্তি—এগুলো এক অদ্ভুত নেশা। হেরোইনের চেয়েও মারাত্মক। এই নেশা একবার যাকে পেয়ে বসে, সে আর নিজেকে মানুষ মনে করে না; সে নিজেকে ভাবে 'রব'।
না, সে মুখে হয়তো বলে না "আমি তোমাদের রব", কিন্তু তার আচরণ, তার দম্ভ, আর তার দিগি্বদিগহীন ছুটে চলা বলে দেয়—সে নিজেকে অবিনশ্বর ভাবছে। সে ভাবছে, এই সূর্যটা বোধহয় তার হুকুমে ওঠে, এই বাতাস তার অনুমতি নিয়ে বয়।
কিন্তু রবকে ভুলে যাওয়ার এই যে আয়োজন, এই যে ক্ষমতার মস্ত বড় প্রদর্শনী—এর শেষটা কোথায়?
আসুন, একটু ইতিহাসের ধুলোবালি ঘেঁটে দেখি। ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর শিক্ষক, সে কাউকে ক্ষমা করে না। আপনি নমরুদের কথা জানেন। সেই নমরুদ, যার ক্ষমতার দাপটে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খেত। সে কি আজকের দিনের কোনো সাধারণ নেতার মতো ছিল?
মোটেও না। তার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। সে আকাশের দিকে তীর ছুড়েছিল। ভাবুন তো, কতটা স্পর্ধা থাকলে, কতটা মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে একজন মানুষ আকাশের মালিককে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
নমরুদ ভেবেছিল তার রাজপ্রাসাদ, তার সেনাবাহিনী, তার অঢেল সম্পদ তাকে রক্ষা করবে। সে ইব্রাহিম (আ.)-এর দাওয়াতকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিল। তার যুক্তি ছিল খুব সরল কিন্তু ভয়ংকর—"জীবন ও মৃত্যু তো আমার হাতে। আমি যাকে চাই মারতে পারি, যাকে চাই বাঁচাতে পারি।"
আজকের আধুনিক নমরুদরাও কি একই কথা ভাবছে না?
আজকের যুগে যারা ক্ষমতার মসনদে বসে আছে, তারা কি ভাবছে না—"এই অর্থনীতির চাকা আমার হাতে, এই মিডিয়া আমার কথায় চলে, এই পারমাণবিক বোমার সুইচ আমার পকেটে। আমিই তো সব!"?
কিন্তু নমরুদের পতন কীভাবে হয়েছিল? কোনো বিশাল উল্কাপাত তাকে ধ্বংস করেনি। কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী এসে তাকে লেজার দিয়ে ভস্ম করে দেয়নি। তাকে ধ্বংস করেছিল অতি ক্ষুদ্র, তুচ্ছ এক মশা।
হ্যাঁ, একটি মশা। যে মশাটিকে আপনি হাতের আলতো থাপ্পড়ে মেরে ফেলেন, সেই মশাই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাধর স্বৈরাচারকে পাগল বানিয়ে দিয়েছিল। মশাটি তার নাকে ঢুকে মগজে কামড়াত। আর সেই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে নমরুদ তার নিজের মাথায় জুতো দিয়ে আঘাত করার নির্দেশ দিত। ভাবা যায়? যে মাথায় রাজমুকুট ছিল, যে মাথায় অহংকারের আকাশচুম্বী দম্ভ ছিল, সেই মাথায় নিজের খাদেমের জুতোর বাড়ি খেয়ে তাকে মরতে হয়েছে।
রব এভাবেই শিক্ষা দেন। তিনি দেখান যে, তোমার পারমাণবিক বোমা, তোমার ড্রোন টেকনোলজি, তোমার স্যাটেলাইট নজরদারি—সবই অসার, যদি আমি একটি অদৃশ্য ভাইরাস বা একটি ক্ষুদ্র মশা লেলিয়ে দেই।
আর ফেরাউন? তার ক্ষমতার ব্যাপ্তি ছিল আরও ভয়ানক। সে তো নিজেকে সরাসরি খোদাই দাবি করে বসেছিল। নীল নদের পানি তার হুকুমে প্রবাহিত হয়—এমনটাই সে বিশ্বাস করাতো তার প্রজাদের। তার ইমান ছিল না, ছিল কেবল ক্ষমতার অন্ধ মোহ। সে মুসা (আ.)-কে জাদুকর ভেবেছিল, সত্যকে ভেবেছিল প্রলাপ।
ফেরাউন যখন সাগরের বুক চিরে তৈরি হওয়া রাস্তার মাঝখানে, তখনো তার হুঁশ ফিরল না। দুপাশে পানির বিশাল দেয়াল, মাঝখানে সে এবং তার অহংকার। সে ভাবল, "প্রকৃতিও আমাকে ভয় পায়।" কিন্তু যখন পানি আছড়ে পড়ল, যখন নোনা জল তার ফুসফুসে ঢুকতে শুরু করল, তখন সে চিৎকার করে বলেছিল—"আমি মুসার রবের প্রতি ইমান আনলাম।" কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তওবার দরজা তখন বন্ধ।
এখন প্রশ্ন হলো, নমরুদ আর ফেরাউন কি মরে গেছে?
ইতিহাস বলে—হ্যাঁ, তারা মৃত। কিন্তু আধ্যাত্মিক দষ্টিতে তাকালে দেখবেন—না, তারা মরেনি। তাদের শরীর পচে গলে গেছে, মমি হয়ে মিউজিয়ামে পড়ে আছে, কিন্তু তাদের 'আত্মা' বা তাদের 'প্রেতাত্মা' আজও বেঁচে আছে।
আজকের সমাজে তাকালে আপনি ভূরি ভূরি নমরুদ আর ফেরাউন দেখতে পাবেন। এরা কারা?
এরা তারাই, যারা ক্ষমতার চেয়ারে বসে ন্যায়-অন্যায় ভুলে যায়। যারা ভাবে, "আমাকে ধরার কেউ নেই।" যারা কলমের খোঁচায় এতিমের সম্পদ গ্রাস করে নেয়। যারা নিরপরাধ মানুষকে জেলের অন্ধকারে পচিয়ে মারে। যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য পুরো একটা জনপদকে ধ্বংস করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
আপনি কি ভাবছেন নমরুদ শুধু রাষ্ট্র চালায়?
না। আপনার আমার ভেতরেও একটা করে নমরুদ বাস করে। যখন আপনি আপনার অধীনস্থ কর্মচারীর সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, তখন আপনি নমরুদ। যখন আপনি আপনার স্ত্রীর বা সন্তানের ন্যায্য অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করেন শুধু আপনার পাওয়ার আছে বলে, তখন আপনি ফেরাউনের উত্তরসূরি। যখন আপনি রবের দেওয়া রিজিক খেয়ে রবেরই বিধানকে উপহাস করেন, তখন আপনার আর আবু লাহাবের মধ্যে পার্থক্য থাকে না।
ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। একে বলা হয় 'ইস্তিদ্রাজ' বা ঢিল দেওয়া। আল্লাহ মাঝে মাঝে জালিমকে দড়ি আলগা করে দেন। তাকে উপরে উঠতে দেন। সে উঠতে থাকে, উঠতে থাকে। সে ভাবে, "আল্লাহ যদি থাকতেন, তাহলে তো আমাকে শাস্তি দিতেন। কই, আমার তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না! আমার ব্যাংক ব্যালেন্স তো বাড়ছেই, আমার শরীর তো সুস্থই আছে।"
সে জানে না, সে আসলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে না, সে উঠছে এক ভয়ংকর খাদের কিনারায়। যত উপরে সে উঠবে, তার পতনের শব্দ তত বিকট হবে। রব তাকে ছাড় দেন, কিন্তু ছেড়ে দেন না।
বাস্তবতার দিকে তাকান। হাসপাতালের আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছেন কখনো? সেখানে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকান। গতকালও হয়তো তিনি ছিলেন কোনো এক বিশাল শিল্পগোষ্ঠীর মালিক। তার এক ইশারায় হাজার হাজার কোটি টাকার ডিল হতো। আর আজ? আজ তার নিজের নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাটুকুও নেই। মেশিনের পাইপ তার নাকে, মুখে। ভেন্টিলেটরের যান্ত্রিক শব্দে তার জীবন ঝুলে আছে।
কোথায় তার সেই ক্ষমতা? কোথায় তার সেই হুঙ্কার? যে আঙুল উঁচিয়ে তিনি ধমক দিতেন, সেই আঙুলটি নাড়ানোর শক্তিও আজ তার নেই। ডাক্তাররা যখন বলে, "সরি, আমাদের আর কিছু করার নেই"—তখন তার হাজার কোটি টাকা, তার মন্ত্রিত্ব, তার গদি—সবই এক দলা থুতুর চেয়েও মূল্যহীন মনে হয়।
রবকে ভুলে যাওয়ার মাসুল এভাবেই দিতে হয়। আমরা ভুলে যাই যে, আমাদের এই সাজানো জীবনটা আসলে মাকড়সার জালের মতো। বাইরে থেকে দেখতে খুব সুন্দর জ্যামিতিক নকশা, কিন্তু সামান্য বাতাসের ঝাপটায় তা ছিঁড়ে তছনছ হয়ে যায়।
একটা ভাইরাসের কথাই ধরুন না। করোনা এসে আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে গেল?
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো, যাদের পারমাণবিক বোমার ভাণ্ডার দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব, তারা একটা আণুবীক্ষণিক জীবাণুর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তাদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, তাদের অহংকারী বিজ্ঞান—সবই অসহায় হয়ে পড়ল। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ রাস্তায় কাতরালো। কই, নমরুদের উত্তরসূরিরা তো বাতাস তৈরি করতে পারল না?
তবুও আমাদের শিক্ষা হয় না। আমরা ভুলে যাই। মানুষের সবচেয়ে বড় রোগ হলো 'বিস্মৃতি'। আমরা রবকে ভুলে যাই, আখেরাতকে ভুলে যাই, কবরের সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারকে ভুলে যাই।
একবার ভাবুন তো কবরের কথা। না, ভৌতিক কোনো গল্পের মতো করে নয়। বাস্তবিক চিন্তা করুন। আজ যে শরীরটাকে আপনি দামী লোশন মাখাচ্ছেন, জিম করে ফিট রাখছেন, যে চেহারার যত্ন নিতে হাজার টাকা খরচ করছেন—সেই শরীরটা মাটির নিচে শুয়ে থাকবে। একা। কোনো এসি নেই, কোনো ফ্যান নেই, কোনো লোশন নেই। আছে শুধু মাটি আর পোকামাকড়।
আপনার এই ক্ষমতা, এই দাপট কি মাটির পোকাদের থামাতে পারবে? তারা যখন আপনার চোখটা খুবলে খাবে, তখন কি আপনি বলতে পারবেন—"স্টপ! ডু ইউ নো হু আই এম? আমি অমুক কোম্পানির সিইও!"?
পারবেন না। সেখানে আপনার পরিচয় আপনার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে হবে না। সেখানে আপনার পরিচয় হবে আপনার 'ঈমান' দিয়ে।
ফেরাউন আজ মিশরের জাদুঘরে শুয়ে আছে। তার শরীরটা অক্ষত রাখা হয়েছে। কেন জানেন? এটা রবের একটা নিদর্শন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, তিনি ফেরাউনের লাশকে সংরক্ষণ করবেন যাতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
প্রতিদিন হাজার হাজার টুরিস্ট ফেরাউনের মমি দেখতে যায়। তারা তাকে দেখে কী ভাবে? তারা কি তাকে সম্মান করে?
না। তারা তাকে দেখে একটা মৃত, অসহায় বস্তু হিসেবে। কেউ কেউ হয়তো করুণার দৃষ্টিতে তাকায়। ভাবুন তো, যে লোকটা নিজেকে খোদা দাবি করেছিল, আজ সে একটা কাঁচের বাক্সে বন্দি, মানুষের দেখার খোরাক। এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে?
অথচ, যারা ঈমান এনেছিল, যারা ক্ষমতার দাপটে নত হয়নি, যেমন আসিয়া (আ.)—ফেরাউনের স্ত্রী। তিনি রাজপ্রাসাদের আরাম-আয়েশ লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলেন সত্যের জন্য। ফেরাউন তাকে মরুভূমির তপ্ত বালুতে শুইয়ে বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়ে হত্যা করেছিল। কিন্তু আসিয়া (আ.) কি হেরে গেছেন?
না। আজ হাজার বছর পরেও কোটি কোটি মানুষ আসিয়া (আ.)-এর নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। জান্নাতে তার জন্য ঘর তৈরি হয়ে আছে।
ক্ষমতা আসলে কার? যে জোর করে শরীর দখল করে, তার? নাকি যে আত্মা জয় করে নেয়, তার?
নমরুদ, ফেরাউনরা শরীর দখল করতে চেয়েছিল, কিন্তু মুসা (আ.) বা ইব্রাহিম (আ.) মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন রবের ভালোবাসা দিয়ে।
আজকের যুগে আমাদের চারপাশটা বড় বেশি চাকচিক্যময়। কৃত্রিম আলোয় আমরা আসল আলো হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের পকেটে ক্রেডিট কার্ড আছে, কিন্তু হৃদয়ে 'ক্রেডিট' নেই। আমাদের সোশাল মিডিয়ায় হাজার হাজার ফলোয়ার আছে, কিন্তু জানাজার নামাজে দাঁড়ানোর মতো খাঁটি মানুষ নেই।
আমরা রবকে ভুলে গিয়েছি কারণ আমরা কারণকে কর্তা বানিয়ে ফেলেছি। আমরা মনে করি, "আমি পরিশ্রম করেছি তাই সফল হয়েছি।" "আমার বুদ্ধিতেই এই প্রজেক্টটা পাশ হয়েছে।" অবশ্যই পরিশ্রমের দাম আছে, কিন্তু সেই পরিশ্রম করার শক্তিটা কে দিল? সেই বুদ্ধিটা কার দান?
মস্তিষ্কের একটা অতি সূক্ষ্ম শিরা যদি ছিঁড়ে যায়, আপনার এই বিশ্বজয়ী বুদ্ধি মুহূর্তে লোপ পাবে। আপনি পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরবেন। এই যে শিরাটা ছিঁড়ছে না, রক্ত চলাচল স্বাভাবিক আছে—এটা কার দয়া? এটা কি আপনার কৃতিত্ব?
অথচ এই সুস্থ মস্তিষ্ক দিয়ে আপনি রবের অস্তিত্বকে অস্বীকার করছেন। আপনি ভাবছেন, বিজ্ঞানই সব। বিজ্ঞান তো কেবল রবের সৃষ্টির ব্যাখ্যা দেয় মাত্র, বিজ্ঞান তো স্রষ্টা নয়।
যারা ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছে, তাদের জন্য এই দিনগুলো বড় পরীক্ষার। ক্ষমতা হলো আগুনের মতো। এতে রান্নাও করা যায়, আবার এতে ঘরও পোড়ানো যায়। যার হাতে ক্ষমতা আছে, তার কাঁধে দায়িত্বের বোঝা পাহাড়সমান।
হযরত উমর (রা.)-এর কথা মনে পড়ে? অর্ধ পৃথিবীর শাসক ছিলেন তিনি। অথচ তিনি রাতে ঘুমাতে পারতেন না। তিনি বলতেন, "ফোরাত নদীর তীরে যদি একটা কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তবে কেয়ামতের দিন উমরকে তার জবাবদিহি করতে হবে।"
আর আজকের শাসকরা? আজকের ক্ষমতাধররা? তাদের প্রাসাদের পাশেই মানুষ না খেয়ে মরে, ন্যায়বিচার না পেয়ে কাঁদে। আর তারা তখন ব্যস্ত থাকে নিজেদের ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করার ষড়যন্ত্রে। তারা ভুলে যায়, এই দিনই শেষ দিন নয়। বিচারক একজন আছেন, যার এজলাসে কোনো উকিল নেই, কোনো মিথ্যা সাক্ষ্য নেই, কোনো ঘুষ চলে না।
সেখানে ফেরাউন তার সেনাবাহিনী নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। নমরুদ তার রাজত্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আর আপনি? আপনি আপনার পদ-পদবি, আপনার পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। সেখানে কথা বলবে আপনার হাত, আপনার পা, আপনার চামড়া।
আমরা বড় আজব এক সময়ে বাস করছি। এখানে পাপকে বলা হয় 'স্মার্টনেস', আর ঈমানকে বলা হয় 'ব্যাকডেটেড'। এখানে সুদ খাওয়াকে বলা হয় 'বিজনেস স্ট্র্যাটেজি', আর পর্দা করাকে বলা হয় 'রক্ষণশীলতা'। এই উল্টো স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা ভাবছি আমরা খুব প্রগতিশীল।
আসলে আমরা প্রগতিশীল নই, আমরা 'পতনশীল'। আমরা সেই খাদের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি, যে খাদে নমরুদ আর ফেরাউন তলিয়ে গিয়েছিল।
ক্ষমতার এই দিনে রবকে ভুলে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে, কারণ শয়তান আমাদের সামনে এই মরিচিকাটাকে খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করে। সে বলে, "উপভোগ করো। এই তো সময়। জীবন একটাই।"
হ্যাঁ, জীবন একটাই। আর তাই এই এক জীবনকে জুয়ার টেবিলে বাজি ধরাটা কি বোকামি নয়? অনন্তকালের জীবনের বিনিময়ে এই ক্ষণস্থায়ী ক্ষমতার স্বাদ নেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?
একবার ভাবুন, আজ থেকে ১০০ বছর পর আপনার এই ক্ষমতা, এই দাপট, এই নামডাক—কোথায় থাকবে? আপনার কবরের নামফলকটাও হয়তো মুছে যাবে। আপনার হাড়গোড় মাটির সাথে মিশে যাবে। পৃথিবীর মানুষ আপনাকে মনে রাখবে না। ঠিক যেমন আপনি আপনার দাদার বাবার নাম মনে রাখেননি।
কিন্তু একজন মনে রাখবেন। তিনি রব। তিনি ভুলেন না। তিনি সব লিখে রাখছেন। আপনার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস, আপনার মনের প্রতিটি গোপন অহংকার, ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতিটি মুহূর্ত—সব রেকর্ড হচ্ছে।
[ক্ষমতার মরীচিকা ও বিস্মৃত নফসের আহাজারি
(১ম পর্ব)]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Comment
Share
Send as a message
Share on my page
Share in the group