এই নিঃস্বতা এমন এক অবস্থা, যেখানে মানুষের হাত ভরে ওঠে প্রাচুর্যে, কিন্তু হৃদয় থাকে শুষ্ক মরুভূমির মতো। বাহ্যিক সফলতা আকাশচুম্বী হলেও, আত্মা থাকে চির-অতৃপ্ত, ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত। এটি এমন এক নিঃস্বতা, যা জগতের কোনো ব্যাংক বা সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না।
আত্মার নিঃস্বতা: জীবনের সমস্ত নিয়ামত ও বরকতের মূল কেন্দ্র হলো ক্বলব বা হৃদয়। যখন এই কেন্দ্রটি তার স্রষ্টার সঙ্গে সংযোগ হারায়, তখন জীবনের সমস্ত আলো ম্লান হয়ে যায়।
আত্মার নিঃস্বতা হলো সেই পরিস্থিতি, যখন হৃদয়ের আয়না গুনাহর কালিমায় এতোটাই ঢেকে যায় যে, তাতে আর সত্যের আলো প্রতিফলিত হয় না। এই নিঃস্বতার প্রধান লক্ষণ হলো—ইবাদতে স্বাদের অনুপস্থিতি।
মানুষ নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, কিন্তু তার মন তাতে তৃপ্তি পায় না। এটি ঠিক যেন সুস্বাদু খাবার সামনে থাকার পরও জিভে কোনো স্বাদ না পাওয়া। সে বুঝতে পারে, তার আমলগুলো কেবল কিছু শারীরিক অনুশীলনে পরিণত হয়েছে, যেখানে আত্মার কোনো অংশগ্রহণ নেই। এই স্বাদহীনতা হলো প্রথম সংকেত যে—জীবনের মূল নিয়ামতটি হারিয়ে গেছে।
আন্তঃসম্পর্কিত কারণসমূহ: আত্মার এই নিঃস্বতা রাতারাতি আসেনি; এটি আমাদের অসচেতন জীবনযাপনের ফসল। এটি একটি চক্র, যেখানে এক দুর্বলতা অন্য দুর্বলতাকে আকর্ষণ করে:
• শুরুর দুর্বলতা: যখন মানুষ সামাজিক মাধ্যমে বা ব্যক্তিগত জীবনে হায়া (লজ্জা ও শালীনতা) নামক অভ্যন্তরীণ ঢালটি সরিয়ে দেয়, তখন তার গোপনীয়তা ও পবিত্রতা নষ্ট হয়। সে সহজেই অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের নেশায় ডুবে যায়।
• প্রথম পতন: হায়া দুর্বল হওয়ায় গুনাহ করা সহজ হয়ে যায়। যখন মানুষ সেই গুনাহর উপর অটল থাকে এবং তাওবাহ না করে, তখন একে একে তার জীবন থেকে বরকত ও কল্যাণের নিয়ামত সরে যায় (যেমন—সময়ের বরকত, সুস্থতার বরকত)।
• দ্বিতীয় পতন: তাওয়াক্কুলের অভাব জীবনের বরকত চলে যাওয়ায় তার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় না। ফলস্বরূপ, সে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করতে শুরু করে। স্রষ্টার ফয়সালার উপর তার আস্থা কমে যায়। হৃদয়ের স্বাধীনতা (তাওয়াক্কুল) হারিয়ে সে দুশ্চিন্তার দাস হয়ে পড়ে।
• চূড়ান্ত পতন: তাওয়াক্কুল না থাকায় সে সবসময় নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে এবং আরও বেশি কিছুর জন্য ছুটতে থাকে। এই অতিরিক্ত প্রত্যাশার ভারে তার হাতে যা আছে, তার প্রতি সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। হৃদয়ের শান্তি (কানা\'আত) চিরতরে বিদায় নেয়।
এই চক্রে পড়ে মানুষ ক্রমাগত ছুটতে থাকে, কিন্তু তার অন্তরের শূন্যতা কেবল বাড়তেই থাকে। সে বাহ্যিকভাবে যত বেশি অর্জন করে, অভ্যন্তরীণভাবে তত বেশি নিঃস্ব হতে থাকে।
আধুনিক সমাজের মানুষ কেন এতো হতাশাগ্রস্ত, কেন এতো দ্রুত মেজাজ হারায়—এর কারণ নিহিত এই আত্মার নিঃস্বতায়। নিঃস্ব আত্মার কিছু স্পষ্ট লক্ষণ আছে, যা আমরা আমাদের চারপাশেই দেখতে পাই:
• অবিরাম অস্থিরতা: সময়ের বরকত না থাকায় মানুষ সর্বদা তাড়াহুড়ো করে। তার কোনো কাজে মন বসে না, তার জীবনে কোনো স্থিরতা নেই। সে দ্রুত এক কাজ থেকে অন্য কাজে যেতে চায়, কিন্তু কোনো কাজই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পারে না।
• সম্পর্কগত অগভীরতা: আত্মার নিঃস্বতা মানুষকে অন্য মানুষের সঙ্গে আন্তরিক সংযোগ স্থাপন করতে দেয় না। সম্পর্কগুলো হয়ে যায় স্বার্থের বা প্রয়োজনের ভিত্তিতে। সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে তা ভেঙে যায়, কারণ হৃদয়ে \'রহম\' (দয়া) ও \'মহব্বত\' (ভালোবাসা) নামক নিয়ামতগুলো আর অবশিষ্ট নেই।
• মানসিক ভারাক্রান্ততা: সামান্য ব্যর্থতা বা সমালোচনাতেই সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। দুশ্চিন্তা তাকে ঘুমাতে দেয় না। তার মন সব সময় ভয় ও আশঙ্কায় আচ্ছন্ন থাকে। সে পৃথিবীতে সবথেকে নিরাপদ স্থানে থেকেও নিজেকে অনিরাপদ মনে করে।
• লোভ ও কার্পণ্য: সন্তুষ্টি বা কানা\'আত না থাকায় তার লোভ বাড়ে। সে আরও সম্পদ জমা করতে চায়, কিন্তু সেই সম্পদ অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা বা বরকত তার থাকে না।
এই মানুষটি আসলে জগতের সবথেকে অসহায় মানুষ—কারণ তার সমস্যা বাইরে নয়, তার ভেতরে। তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অর্থ নয়, প্রয়োজন আত্মিক পরিশুদ্ধি।
• প্রতারণার মরীচিকা: বাইরের আলো ও ভেতরের অন্ধকার
আধুনিক জীবন আমাদের একটি ভয়াবহ মরীচিকার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমরা ধরে নিয়েছি, যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি হাসে, সবচেয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে বা সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়ায়, সে-ই সুখী।
কিন্তু আত্মার নিঃস্বতার নির্মমতা হলো—এই বাহ্যিক চাকচিক্য কেবল ভেতরের শূন্যতাকে ঢেকে রাখে।
একজন মানুষ হয়তো বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বাস করছে, কিন্তু তার ঘরে শান্তি নেই। সে দামি পোশাক পরে নিজেকে সাজাচ্ছে, কিন্তু তার হৃদয় নগ্ন। সে শত মানুষের ভিড়েও নিজেকে একা অনুভব করছে। এটি হলো সেই আত্মার নিঃস্বতা, যা মানুষকে জীবনের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে এক আত্মঘাতী পথে চালিত করে। কারণ সে তার সমস্ত জীবন ব্যয় করেছে এমন সম্পদ অর্জনে, যা হৃদয়ের ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম।
অভ্যন্তরীণ প্রাচুর্যের পথে ফেরা: আত্মার নিঃস্বতা থেকে মুক্তি লাভের পথটি কেবল একটিই—স্রষ্টার দিকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসা এবং পূর্বে হারানো নিয়ামতগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা। এটি কোনো একক কাজ নয়, বরং একটি সমন্বিত আধ্যাত্মিক চিকিৎসা।
• তাওবার অস্ত্রোপচার: সর্বপ্রথম প্রয়োজন গুনাহের পথ থেকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসা। তাওবাহ হলো হৃদয়ের প্রথম অস্ত্রোপচার। এটি সমস্ত গুনাহর কালিমা মুছে ফেলে, যা বরকতের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। যখন গুনাহ বন্ধ হয়, তখন নিয়ামত হারানোর প্রক্রিয়া থেমে যায় এবং স্রষ্টার রহমত নতুন করে জীবনে প্রবেশ করতে শুরু করে।
• যিকির ও ইখলাসের খাদ্য: হৃদয়ের শক্তি ও পবিত্রতা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন স্রষ্টার নিরন্তর স্মরণ বা যিকির। এই যিকির হৃদয়ের মরিচা দূর করে। একই সঙ্গে, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি আমল—তা লোক দেখানো হোক বা একান্ত গোপনে—কেবল স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য করা (ইখলাস)। এটি আমাদের হায়া ও পবিত্রতাকে পুনরুদ্ধার করে।
• তাওয়াক্কুল ও কানা\'আতের ঢাল: জীবনের দুশ্চিন্তা থেকে স্থায়ী মুক্তি পেতে তাওয়াক্কুলকে অভ্যাস করুন। মনে রাখুন—রিযিক স্রষ্টার হাতে, আর আপনার কাজ হলো চেষ্টা করা। এই নির্ভরতা আপনার মনকে বর্তমানের প্রতি সন্তুষ্ট (কানা\'আত) করে তুলবে। অন্যের জীবনের দিকে তাকানো বন্ধ করুন এবং আপনার যা আছে, তাতে স্রষ্টার কল্যাণ খুঁজুন। এই ঢাল আপনাকে অতিরিক্ত প্রত্যাশার ভার থেকে মুক্ত রাখবে।
• গোপনীয়তার অনুশীলন: ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার জীবনের কিছু সফলতা এবং ইবাদতের কিছু অংশ গোপন রাখুন। এটি আপনার আত্মিক পবিত্রতা বাড়াবে এবং হায়ার নিয়ামতকে দৃঢ় করবে। এটি আপনাকে মানুষের প্রশংসা নামক ক্ষণস্থায়ী মাদক থেকে বাঁচিয়ে দেবে।
পাঠক, আত্মার নিঃস্বতা হলো আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। হয় আমরা পৃথিবীর পেছনে ছুটতে ছুটতে অভ্যন্তরীণভাবে নিঃস্ব হয়ে যাব, নয়তো আমরা অভ্যন্তরীণ প্রাচুর্যের সন্ধান করে পৃথিবীর সমস্ত ভার থেকে নিজেদের মুক্ত করব।
স্মরণ রাখবেন, যে ব্যক্তি হৃদয়ে তাওয়াক্কুল ও কানা\'আত ধারণ করে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। কারণ তার কোনো ভয় নেই, কোনো অপ্রাপ্তি নেই। আর যে ব্যক্তি হৃদয়ের এই নিয়ামতগুলো হারিয়েছে, সে পৃথিবীর সব সম্পদের মালিক হয়েও সবচেয়ে নিঃস্ব ও অসহায়।
আসুন, আমরা বাহ্যিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ সচ্ছলতার পথে হাঁটি। কারণ জীবনের আসল সফলতা হাতে নয়, অন্তরে।
এই ৪ পর্বের গভীর আলোচনা এখানেই সমাপ্ত হলো। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
[আধুনিক জীবনে আত্মার নিঃস্বতা (৪র্থ এবং শেষ পর্ব)]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
এই নিঃস্বতা এমন এক অবস্থা, যেখানে মানুষের হাত ভরে ওঠে প্রাচুর্যে, কিন্তু হৃদয় থাকে শুষ্ক মরুভূমির মতো। বাহ্যিক সফলতা আকাশচুম্বী হলেও, আত্মা থাকে চির-অতৃপ্ত, ক্লান্ত ও ভারাক্রান্ত। এটি এমন এক নিঃস্বতা, যা জগতের কোনো ব্যাংক বা সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না।
আত্মার নিঃস্বতা: জীবনের সমস্ত নিয়ামত ও বরকতের মূল কেন্দ্র হলো ক্বলব বা হৃদয়। যখন এই কেন্দ্রটি তার স্রষ্টার সঙ্গে সংযোগ হারায়, তখন জীবনের সমস্ত আলো ম্লান হয়ে যায়।
আত্মার নিঃস্বতা হলো সেই পরিস্থিতি, যখন হৃদয়ের আয়না গুনাহর কালিমায় এতোটাই ঢেকে যায় যে, তাতে আর সত্যের আলো প্রতিফলিত হয় না। এই নিঃস্বতার প্রধান লক্ষণ হলো—ইবাদতে স্বাদের অনুপস্থিতি।
মানুষ নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, কিন্তু তার মন তাতে তৃপ্তি পায় না। এটি ঠিক যেন সুস্বাদু খাবার সামনে থাকার পরও জিভে কোনো স্বাদ না পাওয়া। সে বুঝতে পারে, তার আমলগুলো কেবল কিছু শারীরিক অনুশীলনে পরিণত হয়েছে, যেখানে আত্মার কোনো অংশগ্রহণ নেই। এই স্বাদহীনতা হলো প্রথম সংকেত যে—জীবনের মূল নিয়ামতটি হারিয়ে গেছে।
আন্তঃসম্পর্কিত কারণসমূহ: আত্মার এই নিঃস্বতা রাতারাতি আসেনি; এটি আমাদের অসচেতন জীবনযাপনের ফসল। এটি একটি চক্র, যেখানে এক দুর্বলতা অন্য দুর্বলতাকে আকর্ষণ করে:
• শুরুর দুর্বলতা: যখন মানুষ সামাজিক মাধ্যমে বা ব্যক্তিগত জীবনে হায়া (লজ্জা ও শালীনতা) নামক অভ্যন্তরীণ ঢালটি সরিয়ে দেয়, তখন তার গোপনীয়তা ও পবিত্রতা নষ্ট হয়। সে সহজেই অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের নেশায় ডুবে যায়।
• প্রথম পতন: হায়া দুর্বল হওয়ায় গুনাহ করা সহজ হয়ে যায়। যখন মানুষ সেই গুনাহর উপর অটল থাকে এবং তাওবাহ না করে, তখন একে একে তার জীবন থেকে বরকত ও কল্যাণের নিয়ামত সরে যায় (যেমন—সময়ের বরকত, সুস্থতার বরকত)।
• দ্বিতীয় পতন: তাওয়াক্কুলের অভাব জীবনের বরকত চলে যাওয়ায় তার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় না। ফলস্বরূপ, সে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করতে শুরু করে। স্রষ্টার ফয়সালার উপর তার আস্থা কমে যায়। হৃদয়ের স্বাধীনতা (তাওয়াক্কুল) হারিয়ে সে দুশ্চিন্তার দাস হয়ে পড়ে।
• চূড়ান্ত পতন: তাওয়াক্কুল না থাকায় সে সবসময় নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে এবং আরও বেশি কিছুর জন্য ছুটতে থাকে। এই অতিরিক্ত প্রত্যাশার ভারে তার হাতে যা আছে, তার প্রতি সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। হৃদয়ের শান্তি (কানা'আত) চিরতরে বিদায় নেয়।
এই চক্রে পড়ে মানুষ ক্রমাগত ছুটতে থাকে, কিন্তু তার অন্তরের শূন্যতা কেবল বাড়তেই থাকে। সে বাহ্যিকভাবে যত বেশি অর্জন করে, অভ্যন্তরীণভাবে তত বেশি নিঃস্ব হতে থাকে।
আধুনিক সমাজের মানুষ কেন এতো হতাশাগ্রস্ত, কেন এতো দ্রুত মেজাজ হারায়—এর কারণ নিহিত এই আত্মার নিঃস্বতায়। নিঃস্ব আত্মার কিছু স্পষ্ট লক্ষণ আছে, যা আমরা আমাদের চারপাশেই দেখতে পাই:
• অবিরাম অস্থিরতা: সময়ের বরকত না থাকায় মানুষ সর্বদা তাড়াহুড়ো করে। তার কোনো কাজে মন বসে না, তার জীবনে কোনো স্থিরতা নেই। সে দ্রুত এক কাজ থেকে অন্য কাজে যেতে চায়, কিন্তু কোনো কাজই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পারে না।
• সম্পর্কগত অগভীরতা: আত্মার নিঃস্বতা মানুষকে অন্য মানুষের সঙ্গে আন্তরিক সংযোগ স্থাপন করতে দেয় না। সম্পর্কগুলো হয়ে যায় স্বার্থের বা প্রয়োজনের ভিত্তিতে। সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে তা ভেঙে যায়, কারণ হৃদয়ে 'রহম' (দয়া) ও 'মহব্বত' (ভালোবাসা) নামক নিয়ামতগুলো আর অবশিষ্ট নেই।
• মানসিক ভারাক্রান্ততা: সামান্য ব্যর্থতা বা সমালোচনাতেই সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। দুশ্চিন্তা তাকে ঘুমাতে দেয় না। তার মন সব সময় ভয় ও আশঙ্কায় আচ্ছন্ন থাকে। সে পৃথিবীতে সবথেকে নিরাপদ স্থানে থেকেও নিজেকে অনিরাপদ মনে করে।
• লোভ ও কার্পণ্য: সন্তুষ্টি বা কানা'আত না থাকায় তার লোভ বাড়ে। সে আরও সম্পদ জমা করতে চায়, কিন্তু সেই সম্পদ অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা বা বরকত তার থাকে না।
এই মানুষটি আসলে জগতের সবথেকে অসহায় মানুষ—কারণ তার সমস্যা বাইরে নয়, তার ভেতরে। তার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অর্থ নয়, প্রয়োজন আত্মিক পরিশুদ্ধি।
• প্রতারণার মরীচিকা: বাইরের আলো ও ভেতরের অন্ধকার
আধুনিক জীবন আমাদের একটি ভয়াবহ মরীচিকার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমরা ধরে নিয়েছি, যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি হাসে, সবচেয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে বা সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়ায়, সে-ই সুখী।
কিন্তু আত্মার নিঃস্বতার নির্মমতা হলো—এই বাহ্যিক চাকচিক্য কেবল ভেতরের শূন্যতাকে ঢেকে রাখে।
একজন মানুষ হয়তো বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বাস করছে, কিন্তু তার ঘরে শান্তি নেই। সে দামি পোশাক পরে নিজেকে সাজাচ্ছে, কিন্তু তার হৃদয় নগ্ন। সে শত মানুষের ভিড়েও নিজেকে একা অনুভব করছে। এটি হলো সেই আত্মার নিঃস্বতা, যা মানুষকে জীবনের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে এক আত্মঘাতী পথে চালিত করে। কারণ সে তার সমস্ত জীবন ব্যয় করেছে এমন সম্পদ অর্জনে, যা হৃদয়ের ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম।
অভ্যন্তরীণ প্রাচুর্যের পথে ফেরা: আত্মার নিঃস্বতা থেকে মুক্তি লাভের পথটি কেবল একটিই—স্রষ্টার দিকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসা এবং পূর্বে হারানো নিয়ামতগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা। এটি কোনো একক কাজ নয়, বরং একটি সমন্বিত আধ্যাত্মিক চিকিৎসা।
• তাওবার অস্ত্রোপচার: সর্বপ্রথম প্রয়োজন গুনাহের পথ থেকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে আসা। তাওবাহ হলো হৃদয়ের প্রথম অস্ত্রোপচার। এটি সমস্ত গুনাহর কালিমা মুছে ফেলে, যা বরকতের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। যখন গুনাহ বন্ধ হয়, তখন নিয়ামত হারানোর প্রক্রিয়া থেমে যায় এবং স্রষ্টার রহমত নতুন করে জীবনে প্রবেশ করতে শুরু করে।
• যিকির ও ইখলাসের খাদ্য: হৃদয়ের শক্তি ও পবিত্রতা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন স্রষ্টার নিরন্তর স্মরণ বা যিকির। এই যিকির হৃদয়ের মরিচা দূর করে। একই সঙ্গে, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি আমল—তা লোক দেখানো হোক বা একান্ত গোপনে—কেবল স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য করা (ইখলাস)। এটি আমাদের হায়া ও পবিত্রতাকে পুনরুদ্ধার করে।
• তাওয়াক্কুল ও কানা'আতের ঢাল: জীবনের দুশ্চিন্তা থেকে স্থায়ী মুক্তি পেতে তাওয়াক্কুলকে অভ্যাস করুন। মনে রাখুন—রিযিক স্রষ্টার হাতে, আর আপনার কাজ হলো চেষ্টা করা। এই নির্ভরতা আপনার মনকে বর্তমানের প্রতি সন্তুষ্ট (কানা'আত) করে তুলবে। অন্যের জীবনের দিকে তাকানো বন্ধ করুন এবং আপনার যা আছে, তাতে স্রষ্টার কল্যাণ খুঁজুন। এই ঢাল আপনাকে অতিরিক্ত প্রত্যাশার ভার থেকে মুক্ত রাখবে।
• গোপনীয়তার অনুশীলন: ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার জীবনের কিছু সফলতা এবং ইবাদতের কিছু অংশ গোপন রাখুন। এটি আপনার আত্মিক পবিত্রতা বাড়াবে এবং হায়ার নিয়ামতকে দৃঢ় করবে। এটি আপনাকে মানুষের প্রশংসা নামক ক্ষণস্থায়ী মাদক থেকে বাঁচিয়ে দেবে।
পাঠক, আত্মার নিঃস্বতা হলো আমাদের যুগের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। হয় আমরা পৃথিবীর পেছনে ছুটতে ছুটতে অভ্যন্তরীণভাবে নিঃস্ব হয়ে যাব, নয়তো আমরা অভ্যন্তরীণ প্রাচুর্যের সন্ধান করে পৃথিবীর সমস্ত ভার থেকে নিজেদের মুক্ত করব।
স্মরণ রাখবেন, যে ব্যক্তি হৃদয়ে তাওয়াক্কুল ও কানা'আত ধারণ করে, সে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। কারণ তার কোনো ভয় নেই, কোনো অপ্রাপ্তি নেই। আর যে ব্যক্তি হৃদয়ের এই নিয়ামতগুলো হারিয়েছে, সে পৃথিবীর সব সম্পদের মালিক হয়েও সবচেয়ে নিঃস্ব ও অসহায়।
আসুন, আমরা বাহ্যিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ সচ্ছলতার পথে হাঁটি। কারণ জীবনের আসল সফলতা হাতে নয়, অন্তরে।
এই ৪ পর্বের গভীর আলোচনা এখানেই সমাপ্ত হলো। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
[আধুনিক জীবনে আত্মার নিঃস্বতা (৪র্থ এবং শেষ পর্ব)]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
Comment
Share
Send as a message
Share on my page
Share in the group
