Translation is not possible.
আজকের আধুনিক জীবনে 'দুশ্চিন্তা' এক মহামারী। মানুষ বাহ্যিকভাবে সুস্থ ও সফল হলেও তার অন্তর ক্রমাগত এক ভারে পিষ্ট। এই ভার হলো—অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, যা ভবিষ্যতকে নিয়ন্ত্রণ করার এক ব্যর্থ চেষ্টা থেকে জন্ম নেয়। এই চেষ্টা কেবল বৃথা নয়, এটি স্রষ্টার ফয়সালার প্রতি এক নীরব অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। আর এই অসন্তোষই তাওয়াক্কুল নামক পবিত্র নিয়ামতটিকে জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
​দুশ্চিন্তা: (বর্তমান মুহূর্তের উপর ধার্যকৃত কর) ​দুশ্চিন্তা হলো এক অদৃশ্য কর, যা আমরা আমাদের বর্তমান মুহূর্তের সুখ ও শান্তির উপর ধার্য করি এমন কিছুর জন্য, যা এখনও ঘটেনি বা যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই দুশ্চিন্তার উৎস দুটি:
​• অতীতের কৃতকর্মের ভয়: যা করে ফেলেছি, তার ফল কী হবে—এই ভয়।
• ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কা: আগামীতে কী ঘটবে—এই আশঙ্কা।
​অথচ একজন মুমিনের জীবনের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত—বর্তমান মুহূর্তের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং ভবিষ্যতের ভার মহান স্রষ্টার হাতে সঁপে দেওয়া। যখন বান্দা এই ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তখন সে স্রষ্টার নির্ধারিত ফয়সালার উপর নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়, যা এক গভীরতর আত্মিক গুনাহ।
​তাওয়াক্কুলের ভুল ধারণা: (অলসতা নয়, হৃদয়ের আত্মসমর্পণ) ​তাওয়াক্কুল বা স্রষ্টার উপর নির্ভরতা এমন এক নিয়ামত, যা নিয়ে প্রায়শই ভুল ধারণা পোষণ করা হয়। অনেকে মনে করে, তাওয়াক্কুল মানে হাত গুটিয়ে বসে থাকা এবং ভাগ্যের উপর সব ছেড়ে দেওয়া। এটি অলসতা, তাওয়াক্কুল নয়।
​তাওয়াক্কুল দুটি অপরিহার্য ধাপের সমন্বয়ে গঠিত:
• আসবাব গ্রহণ: এটি হলো শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম। আমাদের সাধ্যের মধ্যে যা কিছু করা সম্ভব, তার সবটুকু চেষ্টা করা। একজন কৃষক যেমন জমিতে বীজ বপন না করে ফলনের আশা করতে পারে না, তেমনি আমরাও চেষ্টা না করে সফলতার আশা করতে পারি না।
​• অন্তরের অর্পণ: চেষ্টা করার পর ফলাফল কী হবে, সেই ভার হৃদয়ের গভীর থেকে সম্পূর্ণরূপে স্রষ্টার হাতে সঁপে দেওয়া। এই ধাপেই আসে প্রকৃত তাওয়াক্কুল। অর্থাৎ, আমি আমার করণীয়টুকু সম্পন্ন করলাম, কিন্তু ফলাফল আমার হাতে নয়।
​যখন একজন মানুষ এই দুই ধাপকে বিভক্ত করে ফেলে—হয় সে কেবল চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, অথবা সে অলসতা করে—তখনই সে তাওয়াক্কুলের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়। তাওয়াক্কুল হলো চেষ্টা করার পরও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা, এই বিশ্বাসে যে—স্রষ্টা তার বান্দার জন্য যা ফয়সালা করবেন, তা-ই সর্বোত্তম।
​তাওয়াক্কুলের অফুরান নিয়ামতসমূহ: ​যে হৃদয়ে তাওয়াক্কুল নামক নিয়ামতটি সুরক্ষিত থাকে, সেই হৃদয় পৃথিবীর সমস্ত ভয় ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকে। এই নিয়ামতের কিছু অপরিহার্য ফল নিম্নরূপ:
• প্রশান্তির দুর্ভেদ্য প্রাচীর: তাওয়াক্কুল হলো হৃদয়ের সেই দুর্গ, যেখানে কোনো দুশ্চিন্তা প্রবেশ করতে পারে না। যে জানে—তার রিজিকদাতা একজন, এবং তিনি কখনও ভুল করেন না, সে কেন দুশ্চিন্তা করবে? এই প্রশান্তি পার্থিব সম্পদের চেয়েও মূল্যবান, যা কেবল স্রষ্টার কাছেই পাওয়া যায়।
​• রিযিকের বরকত: তাওয়াক্কুল কেবল রিযিক বা জীবিকা এনে দেয় না, রিযিকে বরকতও এনে দেয়। যখন বান্দা কেবল বৈধ উপায়ে চেষ্টা করে এবং ফলাফলের জন্য স্রষ্টার উপর নির্ভর করে, তখন তার অল্প উপার্জনও তাকে মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট মনে হয় (কানা'আতের সঙ্গে সংযোগ)। আর যে ব্যক্তি দুশ্চিন্তা করে হারামের দিকে ধাবিত হয়, তার প্রচুর উপার্জনও তার জন্য যথেষ্ট হয় না।
• অসাধ্য সাধনের শক্তি: তাওয়াক্কুল মানুষকে অসম্ভবকে জয় করার সাহস দেয়। যখন মানুষ জানে—সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে এবং বাকিটা স্রষ্টার হাতে, তখন সে এমন সব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে, যা সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তার ভয়ে এড়িয়ে চলে। এটি হলো মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি।
​• ফয়সালা গ্রহণের ক্ষমতা: দুশ্চিন্তা মানুষকে সিদ্ধান্তহীন করে দেয়। কিন্তু তাওয়াক্কুল হৃদয়ের স্থিরতা এনে দেয়। যে ব্যক্তি স্রষ্টার উপর নির্ভর করে, সে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কারণ তার মন ফলাফলের ভয় দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে না।
• ​দুশ্চিন্তার ভার: (একটি আত্মিক বিপর্যয়) ​অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা কেবল মানসিক চাপ নয়; এটি হলো স্রষ্টার 'তকদীর' বা ফয়সালার প্রতি এক গভীর অশ্রদ্ধা। যখন আমরা ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করি, তখন কার্যত আমরা এই বার্তা দিই যে, "হে স্রষ্টা, আমি মনে করি তুমি পরিস্থিতিকে ততটা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করছ না, যতটা আমি করতে পারি।"
​এই দুশ্চিন্তা আমাদের জীবন থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত ছিনিয়ে নেয়:
​• সুস্থতা ও সময়ের অপচয়: অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা কেড়ে নেয়। এটি হলো সময়ের সবচেয়ে বড় অপচয়, কারণ দুশ্চিন্তা কোনো সমস্যার সমাধান করে না, কেবল সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। যে সময় আমরা ইবাদত, কাজ বা পরিবারের পেছনে ব্যয় করতে পারতাম, সেই সময় কেবল হৃদয়ের ভার বাড়াতে ব্যবহৃত হয়।
• ইবাদতে খুশু-খুযুর অভাব: যে মন দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে, সেই মন নামাজে বা প্রার্থনায় স্থির হতে পারে না। নামাজের মধ্যেও তার চিন্তা থাকে—আগামীকালের বিল, সন্তানের ভবিষ্যৎ বা ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিয়ে। এভাবে তার ইবাদতের স্বাদ এবং খুশু-খুযু নামক নিয়ামতটি সরে যায়। স্রষ্টার সঙ্গে তার সংযোগের তারটি দুর্বল হয়ে পড়ে।
• কৃতজ্ঞতার অভাব: দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন কখনো কৃতজ্ঞ হতে পারে না। কারণ সে সর্বদা ভয় পায় যে, তার হাতে যা আছে, তা হয়তো সে হারিয়ে ফেলবে। সে বর্তমানের নিয়ামতকে উপভোগ না করে কেবল ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। এই ক্রমাগত অকৃতজ্ঞতা তার জীবন থেকে আনন্দের নিয়ামতকে ছিনিয়ে নেয়।
​বাস্তবতার দর্পণে দুশ্চিন্তার চিত্র: (​আজকের সমাজে এই দুশ্চিন্তার ভারের অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান)
• ​শিক্ষিত যুবকের দ্বিধা: একজন যুবক সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছে, কিন্তু সে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করে যে তার ভবিষ্যৎ কী হবে। সে ভুলে যায় যে, তার চেষ্টা ও মেধা ছিল তার সাধ্য, আর রিযিকের ফয়সালা স্রষ্টার হাতে। তার দুশ্চিন্তা তার বর্তমান কাজের গুণগত মান কমিয়ে দেয়।
• ​অভিভাবকের ব্যর্থতা: অনেক অভিভাবক আছেন, যারা সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে এবং সঠিক পরিবেশ তৈরি করতে সবকিছু করেছেন, কিন্তু তবুও তাদের রিযিক নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেন। এই দুশ্চিন্তা তাদের পারিবারিক শান্তি নষ্ট করে এবং সন্তানদের মধ্যে এই বার্তা দেয় যে, জীবনে স্রষ্টার চেয়ে সম্পদই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
• ​সম্পর্কের ভয়: অনেক সময় মানুষ সম্পর্ক হারানোর ভয়ে এমন সব কাজ করে, যা তাদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। কারণ, তারা সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিয়ে স্রষ্টার ফয়সালার উপর নির্ভর না করে নিজেদের দুর্বলতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ফলস্বরূপ, তারা সম্পর্কের মধ্যে তাদের সম্মান এবং নিজস্বতা নামক নিয়ামতটি হারায়।
•​দাসত্ব থেকে মুক্তি: (নির্ভরতার পথে ফেরা ​অতিরিক্ত) দুশ্চিন্তার ভার হলো এক ধরনের দাসত্ব—যা মানুষকে তার নিজের ভয়, নিজের আকাঙ্ক্ষা এবং পৃথিবীর অনিশ্চয়তার দাস বানিয়ে ফেলে। তাওয়াক্কুল হলো এই দাসত্ব থেকে আত্মার স্বাধীনতা।
​এই স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো হৃদয়ে গেঁথে নিতে হবে:
• সীমা জানা: আপনার সাধ্য ও স্রষ্টার ক্ষমতার মধ্যেকার সীমারেখাটি বুঝুন। আপনার সাধ্য হলো চেষ্টা করা, পরিকল্পনা করা এবং কঠোর পরিশ্রম করা। স্রষ্টার ক্ষমতা হলো—ফলাফল নির্ধারণ করা, রিযিক পৌঁছে দেওয়া এবং আপনার জন্য যা মঙ্গল তা ফয়সালা করা। নিজের সীমা অতিক্রম করে ফলাফলের ভার নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
• অতীতে ফিরে তাকানো (ইসহানের স্মরণ): আপনার জীবনে স্রষ্টা এর আগে কতবার অসম্ভব পরিস্থিতি থেকে আপনাকে উদ্ধার করেছেন, তার হিসাব করুন। আপনার অতীতের প্রতিটি সফলতা, প্রতিটি কঠিন পথ থেকে উত্তরণ—সবই স্রষ্টার অনুগ্রহের প্রমাণ। এই প্রমাণগুলো মনে রাখলে ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা কমে যায়।
• দোয়া: তাওয়াক্কুলের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ: দুশ্চিন্তা তখনই জন্ম নেয় যখন আমরা মুখে বলি 'আল্লাহ ভরসা', কিন্তু হৃদয়ে অনুভব করি না। দোয়া হলো তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ প্রকাশ। যখন আপনি আপনার হৃদয়ের সমস্ত ভার স্রষ্টার কাছে সঁপে দেন, তখন আপনার মন হালকা হয়ে যায়। দোয়া কেবল চাওয়ার মাধ্যম নয়, এটি হলো নির্ভরতার অঙ্গীকার।
​তাওয়াক্কুল হলো জীবনের সেই মূল্যবান নিয়ামত, যা একজন মানুষকে নিঃস্ব অবস্থায়ও ধনী করে রাখে এবং সফল অবস্থায়ও বিনয়ী রাখে। এটি আত্মার এমন এক স্থিরতা, যা পার্থিব কোনো কিছুই টলাতে পারে না। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার ভার ঝেড়ে ফেলে এই নির্ভরতার পথে ফেরাটাই একজন মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা।
[তাওয়াক্কুলের নিয়ামত (৩য় পর্ব)]
লেখা: Syed Mucksit Ahmed
image
Send as a message
Share on my page
Share in the group