\"বঙ্গ বাঙ্গালা বাঙ্গালী\" বই পর্যালোচনা–বঙ্গীয় মুসলমানের আত্মপরিচয়ের এক ঐতিহাসিক অনুসন্ধান
লেখক: ফাহমিদ-উর-রহমান
প্রকাশনী: মক্তব প্রকাশন
.
বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। “মুসলমানরা বাঙালি কিনা?” কিংবা “বাঙালি কি আদৌ মুসলমান হতে পারে কিনা?”—এই প্রশ্নগুলো বহুকাল ধরেই বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ে আঘাত হানার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফাহমিদ-উর-রহমান তার ৯০ পৃষ্ঠার ছোট্ট গ্রন্থ \"বঙ্গ বাঙ্গালা বাঙ্গালী\"-তে এই বিতর্কের গভীরে প্রবেশ করেছেন এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন।
.
বইয়ের মূল আলোচনা—
লেখক একেবারে ইতিহাসের শুরু থেকে বাঙালি জাতিসত্তার বিবর্তন এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি এবং মাঝের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সূত্রাকারে হাজির করেছেন।
লেখকের আলোচ্য বিষয়—
• বাঙলার আদিবাসী ও ভূমিপুত্রদের মাঝে আর্যদের আগমন
•আর্যদের দ্বারা স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার দমন
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা বাংলা ভাষার প্রতি আক্রমণ ও অবজ্ঞা
• সেন আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুরবস্থা
বখতিয়ার খিলজির আগমন এবং বাংলা ভাষার পুনরুত্থান
• মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষার বিকাশ
• ইলিয়াস শাহের নেতৃত্বে ইউনাইটেড বাংলা বা শাহ-ই-বাঙ্গাল-এর সূচনা
• ইংরেজ শাসন এবং বাংলার নিপীড়ন
• ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন এবং হিন্দুত্ববাদী প্রভাব
• বাংলা ভাষা থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের লোঘুকরণ
• বাঙালি জাতিয়তাবাদের মোড়কে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি এবং বাঙালি মুসলমানদের বাঙালি জাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস
.
ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ—
বাংলাদেশে আর্যভাষীদের আগমন ঘটে খ্রিস্টপূর্ব যুগেই। মৌর্য শাসনামলে বর্ণাশ্রমবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদ বাংলায় প্রবেশ করে এবং গুপ্ত আমলে উত্তর-পূর্ব বাংলায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম শক্তিশালী হয়। শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজাদের শাসনামলে ব্রাহ্মণ্যবাদ চূড়ান্ত রূপ পায়।
এই অঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠী ছিল অনার্য। আর্যরা নিজেরা বিদেশি হওয়া সত্তেও ব্রাহ্মণ্যবাদের নিকট ইসলাম একটি বিদেশি ধর্ম হিসেবে উপেক্ষিত হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা অনার্য বাঙালি ভূমিপুত্রদের প্রতি ঘৃণার মনোভাব ও অবজ্ঞা বেদ এবং পুরাণেও পাওয়া যায়।
লেখক বইতে এ সংক্রান্ত কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ তুলে ধরেছেন। যেমন, বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ বঙ্গের পুণ্ড্র জাতিকে ‘দস্যু’ বলা, ঐতরেয় আরণ্যক-এ বঙ্গের মানুষকে ‘পক্ষীকল্প’ হিসেবে উল্লেখ করা, আর মহাভারত-এ বঙ্গের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে ‘ম্লেচ্ছ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
.
বাংলা ভাষার বিকাশ—
লেখক তুলে ধরেছেন, বাংলা ভাষার প্রকৃত বিকাশ ঘটে মুসলমান শাসনামলে। এর আগে যেখানে বাংলা ভাষা মূলত ‘দেশি ভাষা’ নামে পরিচিত ছিল, সেখানে বাংলা অক্ষরে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটে মুসলিম আমলে।
ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ বাংলাকে নীচু জাতের ভাষা হিসেবে গণ্য করত এবং সেন আমলে বাংলার ভাষা ও সাহিত্য প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। যেখানে ব্রাহ্মণরা বাংলাকে বরাবরই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেছে সেখানে মুসলমান আমলে হোসেন শাহের দরবারে বাংলা সাহিত্য নতুন প্রাণ পায়। সেন আমলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সংকটে পড়লেও মুসলমান শাসকেরা একে পুনরুজ্জীবিত করেন।
.
এ সময় আবদুল হাকিমের মতো কবিরা বাংলার গৌরব ঘোষণা করেন, যেখানে তিনি বাংলা ভাষাকে অবহেলা করা ব্যক্তিদের দেশত্যাগের পরামর্শ দেন—\"দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়। নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ না যায়।\"
অষ্টাদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্রও দেশ অর্থে \"বাঙ্গালা\" ও \"বাঙ্গালী\" শব্দ ব্যবহার করেছেন।
.
মুসলমান শাসকদের অধীনে বৃহৎ বঙ্গের বিকাশ—
আকবর আলি খান লিখেছেন—\"প্রাচীন কালের বহু ক্ষুদ্র বাংলা নিয়ে মুসলমান শাসকরা গড়ে তোলেন বৃহৎ বঙ্গ।\"
রাজা শশাঙ্ক এবং পাল রাজারা বাংলার রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করলেও তারা সফল হননি। মুসলমান শাসকগণ বাংলাকে প্রথমবারের মতো একটি সুসংহত রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত করেন। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার বিভিন্ন অংশকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘বাঙ্গালা’ নামকরণ করেন এবং ‘শাহ-ই-বাঙ্গাল’ উপাধি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে মোগল আমলে বাংলা সুবাহ নামে একটি সুসংহত প্রদেশে পরিণত হয়।
.
বাঙালি বনাম মুসলমান: বিভাজনের রাজনীতি—
ইংরেজ শাসনামলে বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন শুরু হয়, যা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। বাংলার মুসলিমদের ব্যবহৃত আরবি, ফারসি ও উর্দু শব্দ বাদ দিয়ে কৃত্রিমভাবে সংস্কৃত ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হয়। ফলে মুসলমানদের বাঙালি পরিচয় সংকটে পড়ে।
লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে বাঙালি মুসলমানদের পরিচয়কে সংকুচিত করে কৃত্রিমভাবে \"বাঙালি বনাম মুসলমান\" মেরুকরণ সৃষ্টি করা হয়েছে।
.
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালিদের চার ভাগে ভাগ করেন—আর্য হিন্দু, অনার্য হিন্দু, আর্য-অনার্য মিশ্র হিন্দু ও বাঙ্গালী মুসলমান।
তিনি বলেন, এই চারটি ভাগের মধ্যে রক্তের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে না। ইংরেজদের মতো একক জাতি হিসেবে বাঙালিদের গণ্য করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, বাঙালি জাতি একক কোনো সত্তা নয় বরং বিভক্ত একটি গোষ্ঠী এবং প্রকৃত বাঙালি বলতে শুধুমাত্র আর্য হিন্দুকেই বোঝানো উচিত।
এভাবে তিনি স্পষ্টতই বাঙালি মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে দেখিয়েছেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র আর্য হিন্দু নেতৃত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ভারতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে হিন্দু সংস্কৃতির আধিপত্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি হিন্দিকে ভারতের জাতীয় ভাষা করার পক্ষে অবস্থান নেন এবং মহাত্মা গান্ধির কাছে চিঠি লিখে এর পক্ষে সুপারিশ করেন—\"Hindi is the only possible national language for inter-provincial intercourse in India.\"
অর্থাৎ, তিনি হিন্দিকে ভারতীয় জাতিগত ঐক্যের ভাষা হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। অথচ পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দেন, তখন তাকে একচোখা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ একই অবস্থান নিলেও সমালোচনা করা হয় শুধুই মুসলমানদের।
.
অবশেষে বলতে হয়,
বাঙালি মুসলমানের মুক্তি লাভ অসংখ্যক মোকাবেলায় নিজেদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা গঠনের জন্য ইতিহাসের সঠিক বিশ্লেষণ জরুরি। মুসলমান শাসকরাই বাংলার রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করেছেন এবং বাংলা ভাষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। অথচ আজও বাংলার মুসলমানদের আত্মপরিচয় সংকটের শিকার হতে হয়।
বর্তমানে বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত—বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। যদিও উভয় অঞ্চলের ভাষা বাংলা, তবুও উভয়ের বাংলা ভিন্ন; ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনধারা এবং রাজনৈতিক চেতনা ভিন্ন। শুধুমাত্র সংস্কৃতনির্ভর বাংলা ভাষার আধিপত্য বজায় রেখে দুই বাংলার একত্রীকরণ সম্ভব নয়।
এ থেকে উত্তোলনের জন্য বাঙালি মুসলমানদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় রক্ষায় প্রামাণ্য ইতিহাস জানা ও চর্চা করা প্রয়োজন। তার শুরু হতে পারে এই বইটি। এটি শুধু একটি বই নয়, বরং বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের সন্ধানী পাঠকদের জন্য একটি অপরিহার্য দলিল। আপনি যদি বাংলাভাষী মুসলমান হন, তাহলে বইটি আপনার জন্য অবশ্যই মাস্ট রিড।
নিজের ইতিহাস নিজে জানুন। ধার করা বয়ান ছুড়ে ফেলে নিজের জাতিসত্তার বয়ান নিজে গড়ুন।